নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
সেই ৬০ দশকের কথা। মৃতঃ গঞ্জর আলী মিঞা ছিলেন,তদানিন্তন সময়ের একজন অভিজাত জমিদার। বাড়ী পাবনা জেলার বেড়া থানাধীন ঘোপশিলেন্দা গ্রামে। তিনি ছিলেন দানশীল ও নিরহঙ্কার একজন মানুষ। যে সময়ের কথা, সে সময় গ্রামে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিলো না। মৃতঃ গঞ্জর আলী মিঞা গ্রামের মানুষের সুবিধার জন্য তাঁর নিজ জায়গায় নিজ খরচে স্কুল, মাদ্রাসা ও ঈদগাহ তৈরী করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সেসব স্কুল, মাদ্রাসা ও ঈদগাহ ঘোপশিলেন্দা গ্রামে আজও বিদ্যমান রয়েছে। আজ ৬০ বছর পরেও আশে পাশের দশ গ্রামের মানুষ তাঁকে অত্যন্ত ভক্তি ও শ্রদ্ধা সহকারে স্মরন করে।
জনাব গঞ্জর আলী মিঞার সেজো পূত্র মৃতঃ মতিউর রহমান ছিলেন ঘোপশিলেন্দা গ্রামের প্রথম শিক্ষিত ব্যক্তি। তখনকার সময় স্কুল কলেজ ব্যাপারটা এখনকার সময়ের মতো এতো সহজ ছিলো না। ওনার মুখ থেকেই শোনা একটি কথা না বললেই নয়। উনি বলতেন, “যে বাড়িতে জায়গির থাকতাম সেখান থেকে ২ মাইল দূরের এক বাড়িতে প্রতি বেলায় খেতে যেতাম। জায়গির বাড়ি থেকে স্কুল ছিলো আরও ৩ মাইল দূরের পথ। পুরো রাস্তাটা আমাকে হেঁটে যাতায়াত করা লাগতো। যে বাড়িতে খেতাম সেখান থেকে হেঁটে ফিরে আসতে আসতেই আবার ক্ষুধা লেগে যেতো আমার। ওভাবেই কেরোসিনের কুপি জ্বালিয়ে ক্ষুধায় পেটে পড়াশোনা করতাম”। এভাবে অনেক চড়াই উৎড়াই পেড়িয়ে তিনি একে একে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও বি.কম. পাশ করেন এবং অনেক পরে তিনি রাজশাহী ইউনিভার্সিটি থেকে এল.এল.বি. পাশ করেন। মতিউর রহমান সাহেবের কর্ম জীবন শুরু হয় তাঁরই বাবার স্কূলে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে। শিক্ষক মানে হচ্ছেন গুরু। আজও ঘোপশিলেন্দা গ্রামবাসী তাঁকে গুরু হিসেবেই শ্রদ্ধাভরে স্মরন করে। তিনি নিজে অনেক কষ্ট করে পড়াশোনা করেছেন বলে দেখা গেছে সারাটা জীবন উনি কাউকে না কাউকে বাসায় রেখে নিজ খরচে পড়াশোনা করিয়েছেন। ওনার রোজগারের বড় একটা অংশ এই খাতেই ব্যায় হয়ে যেতো। ২০১২ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারী সন্ধ্যায় এই পূণ্যবান মানুষটি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন।
এবার আসি মূল গল্পে। জনাব মতিউর রহমান সাহেবের একমাত্র পূত্র মুহাম্মাদ মাহবুবুর রহমান সোনার চামচ মুখে নিয়েই জন্ম নিয়েছেন বলা যায়। তিনি তাঁর নিজের বিছানায় খুব কমই ঘুমানোর সুযোগ পেয়েছেন। সবসময় তাঁর বাবার পোষ্যদের কেউ না কেউ তাঁর বিছানা দখল করে রাখতো বলে তিনি সারাটা জীবন বাসার সোফাতে ঘুমিয়েই বেড়ে উঠেছেন। এখন তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারদের একজন।
তিনি সাধু স্বভাবের মানুষ। তাঁর মানব সেবার হাতেখড়ি তাঁরই বাবার কাছ থেকে। বাবার কাছ থেকে তিনি শিখেছেন কিভাবে সৎ হতে হয়, কিভাবে আদর্শ, আলোকিত মানুষ হয়ে উঠতে হয়। যতো টাকা রোজগার করেন তিনি তার ৮০% ব্যায় হয়ে যায় মানব কল্যাণে। একটা মাত্র লুঙ্গী ব্যবহার করেন তিনি। দুইটা লুঙ্গী তাঁর কাছে অপচয় বলে মনে হয়। দ্বিতীয় লুঙ্গীটা কিনতে গেলেই তাঁর মনেহয়, যে টাকাটা খরচ করে তিনি লুঙ্গীটা কিনবেন সেই টাকায় হয়তো একজন এতিমের কয়েক বেলার খাবারের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কি অধিকার আছে আমার একজন এতিমকে অভুক্ত রাখার?
মুহাম্মাদ মাহবুবুর রহমান ১৮ বছর বয়স থেকেই নিয়মিত ব্লাড ডোনার। এখন ডায়াবেটিকের কারনে রক্তদান সম্ভব হয়না আর। ৩৮ বছর বয়সী এই মধ্যবয়সী মানুষটির দু’টি স্বপ্ন রয়েছে। প্রথমত তিনি শান্তিনিকেতনের মতো একটি আশ্রম বানাতে চান যেখানে সাধারন মানুষ ধ্যাণ করা শিখবে, আত্মনিয়ন্ত্রণ শিখবে। পাশাপাশি যারা মেধাবী ও ইচ্ছুক তারা সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং শিখবে। আলোকিত মানুষ তৈরী হবে তাঁর আশ্রমে। নিজে ব্যক্তিগতভাবে দরিদ্র হওয়ার কারনে আপাতত তাঁর এই স্বপ্নটা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। তাঁর দ্বিতীয় স্বপ্ন হচ্ছে, মোহাম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের লিখা সায়েন্স ফিকশন বইগুলোতে যে সর্ব কাজে পারদর্শী সুপার কম্পিউটারগুলো দেখা যায় তেমন একটা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্ট সিষ্টেম তৈরী করা। যে সিষ্টেম মানুষের বাসাবাড়ির নিরাপত্তা থেকে শুরু করে বিনোদনের দায়িত্ব পর্যন্ত নিয়ে নিবে। মানুষের সাথে বন্ধুর মতো কথা বলবে, চিকিৎসার দায়িত্ব নিবে, ব্যালান্সড ফুডের দায়িত্ব নিবে। সোজা কথা, একটা পরিবারের মঙ্গলের জন্য যা যা করা দরকার সব করবে। আবারও আগের প্রসঙ্গে ফিরে যেতে হচ্ছে। ব্যক্তিগতভাবে দরিদ্র হওয়ার কারনে আপাতত তাঁর এই স্বপ্নটাও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। এরকম বড় একটা প্রজেক্ট শেষ করতে হলে যে প্রচুর অভিজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার ও অর্থের প্রয়োজন সেটা তাঁর সামর্থের বাইরে।
আলোকিত পৃথিবীর স্বপ্ন দেখেন যিনি, মানুষের মঙ্গলের স্বপ্ন দেখেন যে সণ্যাসী মানুষটা, আমরা তাঁর সুস্থ্যতা ও কল্যাণ কামনা করি। দোয়া করি, পরম করুনাময় যেনো তাঁর স্বপ্নের আশ্রম ও ইন্টেলিজেন্ট সিষ্টেম তৈরীর কাজ শেষ করার আগে তাঁকে পৃথিবী থেকে তুলে নিয়ে না যান।
You cannot copy content of this page