দিনটা শুক্রবার।প্রতি শুক্রবারের ন্যায় আজও রাবেয়া ফুফি খুব সকালে ঘুম থেকে উঠলেন। ফজরের নামাজ পড়ে সোজা রান্নাঘরে।সুন্দর করে রান্না করে চার বাটির একটি টিফিনে করে রুমির হাতে দিলেন। রাবেয়া খালার বড় মেয়ে রুমি।এবার এইচ এস সি দিবে, উচ্চতায় প্রায় ছ ফুট,গায়ের রঙ শ্যামবর্ণ। খাবারের ব্যাগটি হাতে নিয়ে হেটে চলল রুমি সামনের মোড়ের দিকে। মোড় থেকে একটা রিকশা করে ডিসি অফিস পর্যন্ত আসলো।সেখান থেকে অটোরিকশা করে ছাগলখামার পার হয়ে এসে একটা মোড়ে নামল। রাস্তা পাড় হয়ে দেখা গেল বড় বড় করে লেখা “রাখিব নিরাপদ, দেখাব আলোর পথ”। মানে জেলা কারাগার।খানিকটা পথ হাটলেই প্রধান ফটক।প্রধান ফটক।প্রধান ফটক থেকে অনুমতি নিয়ে একটু ভেতরে প্রবেশ করল।খুব বেশি ভেতরে না,কারণ জনসাধারণের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ।বিগত চার বছর ধরে রুমি প্রতি শুক্রবারে আসে তাই ডিসি সাহেবের থেকে একটা অনুমতি পেয়েছে রুমি। ভেতরে প্রবেশ করে সে তার জায়গাতে দাড়িয়ে রইল।একটু পর একজন কয়েদি আসলো।বয়স আনুমানিক পঞ্চাশের কাছাকাছি।তার নাম আবিদ।আবিদ প্রশ্ন করল ” কেমন আছিস মা? বাড়িতে সবাই কেমন আছে? তোর ভাই কে আসতে বলিস, অনেক দিন হলো ওকে দেখি না।” রুমি কোনো জবাব দিল না।খাবারের ব্যাগটা তার দিকে বাড়িয়ে দিল। নিজের ব্যাগ থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করে তার দিকে বাড়িয়ে দিল। আবিদ বলল, “আমি তোদের কাছে অনেক বড় একটা বোঝা হয়ে দাড়িয়েছি বল।” চোখের কোনাটা ভিজে উঠেছিল। এরপরও রুমির ঠোঁট দিয়ে কোন আওয়াজ বের হলো না। যেন এক দীর্ঘ অভিমান।ধরনীর বুক থেকে যদি শত প্রাণ হারিয়েও যায় তবু যেন তার মুখ থেকে একটি শব্দও বের হতে চায় না। সময় সংক্ষিপ্ত তাই মুহূর্তের মধ্যে বের হয়ে আসলো রুমি।ব্যাগ থেকে রুমাল টা বের করে চোখ টা মুছে নিল আলতো করে। তারপর ফিরে আসলো বাড়িতে,কারো সাথেই কথা বলল না।
আজ থেকে পাচ বছর আগে যেদিন রুমির বাবা আবিদ তার মায়ের কাছে ডিভোর্স পেপার(তালাক নামা) পাঠিয়েছিলেন সেদিন থেকে তার বাবার প্রতি তার মনে এই অভিমানের জন্ম নেয়। রুমির চোখে আবিদ সাহেব একজন অপরাধী। নিজের জেদ কে বজায় রাখতে গিয়ে সেদিন তিনি তালাক নামায় স্বাক্ষর করেছিলেন এবং কিছুদিন পরেই আরেকটি বিবাহ করেছিলেন।
আবিদ সাহেব একজন ব্যবসায়ী।শেয়ার মার্কেটে তিনি অনেক উন্নতি করেছেন।কিন্তু তার একটা বাজে নেশা ছিল, সেটা হলো জুয়া।যখন অনেক লাভবান হতেন তখনই তিনি ক্যাসিনোতে চলে যেতেন। অনেক সম্পত্তি উড়িয়েছেন তিনি।একরাতে যখন তার কাছের নগদ টাকা সব হেরে বসে আছেন তখন ঘোরে পড়ে জয়ের নেশায় শেয়ারের কাগজ লাগিয়ে দেন জুয়ার বোর্ডে। কিন্তু বিধি বাম।সে সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যান।রাতে বাড়িতে ফিরে খালাকে প্রেসার দিতে থাকেন।বলতে থাকেন শেয়ার ডুবি হয়েছে, ভাইয়ের থেকে মানে আমার বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে আসার কথা বলেন। কিন্তু খালা রাজি হয় না।পরেরদিন রুমি আর লিলি কে নিয়ে খালা চলে আসে আমাদের বাড়িতে।খালা একটা চিঠি লিখে আসে,
“শেয়ার ডুবি হয়েছে না কি অন্য কিছু সেটা আমি জানি, নিজের স্বভাব চরিত্রকে যেদিন বদলাতে পারবে সেদিন আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যেও,তার আগে না।”_রাবেয়া
সকালে চিঠি টা পড়ে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হলেন আবিদ সাহেব, সাথে সাথে ফোন লাগিয়েছিলেন খালার ফোনে কিন্তু খালা তার মোবাইল বন্ধ করে রেখেছেন। আবিদ সাহেবের ক্রোধের সীমা রইল না।গত রাতে তার সাথে ঘটে যাওয়া সকল কিছুর জন্য তার স্ত্রীকে দায়ী করলেন। এদিকে বিভিন্ন যায়গা থেকে তিনি লোন নিয়ে শেয়ার ক্রয় করে রেখেছিলেন সেসব জুয়ায় হেরে বসে আছেন।কয়েকদিন পর থেকে শুরু হলো আবিদ সাহেবের আরেক বিপত্তি,লোন দাতা এনজিও গুলো তার ওপর চাপ দেওয়া শুরু করে।তিনি বিভিন্ন যায়গা তে ফোন দিতে থাকেন কিন্তু কোন সমাধান দেখতে পান না। তার সকল রাগ গিয়ে পরে রাবেয়া খালার উপর।তিনিও ঠিক করেন তাকে আর তার ঘরে আনবেন না।
তিন মাস পর,
” আবিদ ইন্টারন্যাশনাল ক্লাব” নামে একটি ক্যাসিনোর মালিক।এনজিও গুলোর সকল লোন পরিশোধ হয়ে গেছে।এখন তিনি শহরের স্বনামধন্য ক্যাসিনো ব্যবসায়ীদের একজন।তার দুঃসময়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন শেখ রায়হান সাহেব।”তোমার বিপদের দিনে সকল প্রকার সাহায্য করব আমি,কিন্তু বিনিময়ে আমার মেয়ে লিজা কে তোমাকে বিবাহ করতে হবে। ভেবে জানিও।”
আবিদের সম্মতিতে বিয়ে হয়, তার দুদিন পূর্বে ডিভোর্স পেপারে স্বাক্ষর করে রাবেয়ার নিকট পাঠিয়ে দেয় আবিদ। আবিদের সাথে লিজার নতুন জীবনের সূচনা ঘটে।
বাংলাদেশ সরকারের আদেশে যখন শুরু হয় ক্যাসিনো অভিযান তখন আবিদের ক্লাবেও অভিযান চালানো হয়।অবৈধ অর্থ ও নেশাদ্রব্য পাওয়া যায় তার ক্লাব থেকে।তার সকল অর্থ সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে তাকে আইনের আওতায় আনা হয়।আদালত তাকে আট বছরের কারাদণ্ড ও জরিমানা করে।তার শ্বশুর শেখ রায়হান সাহেব এসে বলেন,”তুমি এমনই একটি মানুষ, যে কখনো সফল হতে পারবে না,অন্ধকারই তোমার আপন। লিজা তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিয়েছে।”লিজা এসে তাকে বলে “বাবার বাইরে কিছু বলা বা করা আমার পক্ষে সম্ভব না, তাই বাবার সিদ্ধান্ত আমার সিদ্ধান্ত।”
জেল থেকে তিনি আমার নিকট চিঠি লেখেন,
“নিয়াজ,
তোমার খালামনি কে বলে দিও হইতো ভুল করেছিলাম সেদিন।ভুল মানুষ করে, সেটা শোধরাবার একটা সুযোগ তাকে দেওয়া উচিত।ঠিকানা লিখে দিচ্ছি, তোমার খালা যেন এক মুহূর্তের জন্য হলেও দেখা করে।_আবিদ”
“খালা, খালুর চিঠি এসেছে জেল থেকে।তোমাকে দেখা করতে বলেছে একবার।” প্রথমে না সূচক জবাব দেয় খাল, চোখের কোণা ভিজে ওঠে খালার।আমাকে একদিন বলল “নিয়ে যাবি আমাকে? কিন্তু কাউকে বলতে পারবি না।”
আমি নিয়ে যায় তাকে। তাদের দুজনের নীরবে কথা চলে।
এক সময় খালু বলেন,”আমাদের গেছে যে দিন একেবারেই কি গেছে? কিছুই কি নেই বাকী?”
কিছুক্ষণ চুপ থেকে খালা বলল,”রাতের সব তারায় লুকিয়ে আছে দিনের আলোর গভীরে।”
“আমি আছি এমনই এক অন্ধকারে যেখানে তারার আলোও পৌছাবে না, দিনের আলো তো অনেক দূরের কথা”
“আজ তাহলে আসছি, আবার দেখা হবে কোন এক দিনের আলোয়”
চলে আসে রাবেয়া খালা।আর কখনো যায় না সে কিন্তু রিমিকে পাঠান তিনি।অন্ধকার কারাগারে দিন কাটান আবিদ সাহেব, মনে মনে ভাবতে থাকেন এতোটাই জঘন্যতম কাজ তিনি করেছেন, নিজের মেয়েও তাকে বাবা বলে পরিচয় দেয় না।অশ্রুদীঘি বেয়ে চলে তার দুচোখ বেয়ে,সে দিঘির জলও হয়তো কোন এক দিনের আলোয় শুকিয়ে যাবে।
লেখকঃ শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
Leave a Reply