আমি রাস্তায় মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছি। একজন অপরিচিত ব্যক্তি আমাকে বললো, কী হয়েছে?
কেন তুমি এমন বিষন্ন মনে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছো?
কে তুমি?
আমি উত্তর দিলাম দীর্ঘশ্বাসে!
আমি একটা মূর্তি! ইংরেজি ভাষায় যাকে বলে স্টাচু।যার কাজ উপমা মাত্র অবস্থান করা।
ব্যক্তিটি বিস্মিত আমার চোখে তাকিয়ে বললো,
তোমার তোহ রক্ত,মাংস,চামড়া,বিবেক এবং মনুষ্যত্ব সবই আছে। তাহলে তুমি নিজেকে মূর্তি বলে আখ্যায়িত করছো কীভাবে?
আমিঃ-আমি মূর্তি! কেননা আমি ভালো কাজে এগিয়ে যেতে পারিনা সমাজের কটুক্তির ভয়ে।
ব্যক্তিঃ-তুমি তোহ কথা বলতে জানো,তাহলে তুমি মূর্তি হলে কীভাবে?
আমিঃ- আমি কথা বলতে জানি কিন্তু বলতে পারিনা।
ব্যক্তিঃ- কেন?
আমিঃ- আমার বাকস্বাধীনতা নেই!
ব্যক্তিঃ- বাকস্বাধীনতা প্রতিটি ব্যক্তিরই নৈতিক অধিকার। তাহলে কে বলেছে তোমার বাকস্বাধীনতা নেই?
আমিঃ- আমার বাকস্বাধীনতা নেই কেননা আমার সমাজ উচিৎ কথাকে তামাশা আর ঘৃণার চোখে দেখে।আমার সমাজ সঠিক কথা বলা মানুষকে অপছন্দ করে। আমার সমাজ ভদ্রতাকে দূর্বলতা মনে করে।
ব্যক্তিঃ- আচ্ছা! সেটাও মেনে নিলাম।তাই বলে তুমি মূর্তি কেন?
আমিঃ- আমি মূর্তি, কেননা আমি অন্যায়ের প্রতিবাদে অগ্রসর হতে পারিনা সমাজের পারিপার্শ্বিক চাপে,আমাদের সমাজে যে শস্যের ভিতর ভূতের আবাসস্থল।
ব্যক্তিঃ-ধূর বোকা!যারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করেনা নিরপেক্ষ থাকে তারা কী তবে মানুষ নই?
আমিঃ- আমি তোহ নিরপেক্ষ নই।আমি ভালোর দলে!
ব্যক্তিঃ- তাই বলে তুমি মূর্তি কেন?
আমিঃ-আমি মূর্তি,কেননা আমাকে তৈরি করা হয়েছে মূর্তির মতো করে। প্রস্তুত করা হয়েছে জীবনের সওদায়।আমাকে সব আঘাত সহ্য করে নিতে শিখতে হয়েছে।
ব্যক্তিঃ- সত্যিই কী এমনটা!
আমিঃ- হাহ, আমাকে আঘাতের প্রতিবাদে আঘাত তোহ দূরের কথা ভালোবাসা টাও দেওয়ার অধিকার দেওয়া হয়নি।দেওয়া হয়েছে নিস্তব্ধতার অন্ধকার হাতছানি!
ব্যক্তিঃ- তুমি তোহ আমাকে বিড়ম্বনার মধ্যে ফেলে দিলে মশায়।
আমিঃ- সবচেয়ে বড় বিড়ম্বনা তোহ মানুষের বাস্তবিক জীবন।
ব্যক্তিঃ- আচ্ছা বাদ দাও।তুমি পেশাগত দিক থেকে কী করো?
আমিঃ- (নিজের প্রতি অবহেলায় বললাম)আমি একজন শিক্ষিত চাকরিপ্রার্থী বেকার।
ব্যক্তিঃ- (আমার দিকে আড় চোখে চেয়ে) ওহ্ আচ্ছা আচ্ছা! তাহলে তুমি ভবঘুরে। তাই তোমার মুখে এত কথা!
আমিঃ- (করুণভাবে তাকিয়ে বললাম) তোমার সমাজে বুঝি একজন অসহায় বেকার কে তামাশার ছলে ভবঘুরে বলা হয়?
ব্যক্তিঃ- (ইতস্তত হয়ে) না মানে সেটা ঠিক নয়!
আমিঃ- এই জন্যেই আমি বলি আমি একজন মূর্তি!
ব্যক্তিঃ- (কটুক্তি করে)পড়াশোনা জীবনে পড়াশোনাটা ঠিকমতো করোনি বুঝি তাই একটা চাকরিও পাচ্ছো নাহ।
আমিঃ- (মাথা উচু করে বললাম) আমার শিক্ষাজীবনে আমি শুধু শিক্ষায় গ্রহণ করেছি!আমি কখনো ভাবিনি যোগ্যতা বর্তমানে টাকায় বিক্রি হবে।
ব্যক্তিঃ- চাকরির জন্য মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ চাইছে বুঝি?
আমিঃ- (অটৃটহাসি দিয়ে বললাম) ধূর মশায় আমার সমাজে কেউ ঘুষ খায় নাকি?আমার সমাজে ধনীর পরিমাণ কম নেই।তারা চাকরিপ্রার্থী অসহায় যোগ্য বেকারের থেকে টাকা নিয়ে মিষ্টিমুখ করেন।ওই রক্ত ঘামানো মোটা অঙ্কের টাকাকে আমাদের সমাজে ঘুষ বলা হয় নাহ,বলা হয় ওটা উপঢৌকন!
ব্যক্তিঃ- তুমি সেই উপঢৌকনের টাকাটা দিতে পারোনি বুঝি?
আমিঃ- নাহ!
ব্যক্তিঃ- কেন?
আমিঃ- আমি আমার যোগ্যতা,শিক্ষা,নৈতিকতাকে ওই উপঢৌকন নামক চাটুকারী বস্তুর কাছে বিক্রি করতে পারবো নাহ।ওটা করলে আমার ব্যক্তিত্ত্বকে তথাকথিত ভাবে অপমান করা হবে।
ব্যক্তিঃ- ওসব আমার বোঝা হয়ে গেছে তোমার সামর্থ্য নেই তাই তুমি ওতোপ্রোতভাবে গুজব রটাচ্ছো।
আমিঃ- হাহাহা! সামর্থ্য,সক্ষমতা বলতে তোহ তোমরা তথাকথিত অর্থ নামক কাগজের বড় নোটকেই চেনো।শিক্ষার সক্ষমতা তোহ তোমাদের কাছে মূর্তির মতোই উপমা!
ব্যক্তিঃ- আচ্ছা বুঝলাম, তাই বলে কী তুমি সত্যিই মূর্তি হয়ে গেলে নাকি?
আমিঃ- হ্যাঁ আমি মূর্তি!
ব্যক্তিঃ- আর কোনো বিশেষ কারণ?
আমিঃ- আমি মূর্তি কারণ, আমি মধ্যবিত্ত!
ব্যক্তিঃ- ওহ আচ্ছা!
আমিঃ- মধ্যবিত্ত কী জানো?
ব্যক্তিঃ- এতকিছু যখন তুমি জানালে,এটুকুও তুমিই জানিয়ে যাও।
আমিঃ- প্রাচুর্য আর ঐশ্বর্যের পাশাপাশি কী অভাব,কী দূর্গতি,কী নিদারুণ লাঞ্চনা সহ্যকারী সমাজের বিরাট এক শ্রেণীর নাম মধ্যবিত্ত।
ব্যক্তিঃ- মধ্যবিত্তের এতোই যখন অভাব এতোটাই দূর্গতি,এতোই লাঞ্চনা তাহলে পাশাপাশি তাদের প্রাচুর্য আর ঐশ্বর্যের কেন বসবাস?
আমিঃ- (মৃদুস্বরে) নিজের বিবেকের বিদ্রুপ করছো!
এই মধ্যবিত্ত দিনের পর দিন হারিয়ে যাচ্ছে, তলিয়ে যাচ্ছে সমাজের কটুক্তি নামক লোনাজলে।আমাদের সভ্য সমাজের যারা দন্ডমুন্ড কর্তা তারা এটা স্বীকার করতে পর্যন্ত লজ্জা করে, এই মধ্যবিত্তই হচ্ছে আমাদের সমাজের মেরুদণ্ড। কিন্তু এই মধ্যবিত্তই আজ অপমানের বিষাদ সমুদ্রে ভেসে যেতে বাধ্য হয়েছে।
ব্যক্তিঃ- (বিস্মিত হয়ে) আসলেই কী তবে আমি, তুমি,আমরা মূর্তি!
আমিঃ- হ্যাঁ আমরা মানুষরূপী মূর্তি। আমাদের বিচরণ আছে কিন্তু অস্তিত্ব নেই!
লেখকঃ শিক্ষার্থী, জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
প্রতিদিনেরসময়/সোহাগ
Leave a Reply