আজ এক রত্নগর্ভা মায়ের গল্প বলছি। সাধারনের মধ্যেও যিনি ছিলেন অসাধারন, দয়ালু ও ধার্মিক। একজন সাধারন নারীর মত নিজের জগত নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন তিনি। আর ব্যস্ত থাকতেন তার বড় খোকা কে নিয়ে। বড় খোকার পছন্দের খাবার রান্না করা, তার পোশাক গুছিয়ে রাখা। কাঁথা সেলাই করা, বিছানা গুছিয়ে রাখা, বইপত্র ঠিক করে রাখা এ সবই নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। যেন চিরন্তন অতি সাধারণ এক বাঙ্গালী মায়ের প্রতিকৃতি।
সাধারণ হয়েও এ নারী অসাধারন হলেন ১৯২০ সালের ১৭ ই মার্চ। জন্ম দিলেন এক মহানায়কের। তিনি আর কেউ নন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যার জন্ম না হলে একটি দেশ, একটি পতাকা পেতাম না আমরা। আর তাই আজ গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি সেই রত্নগর্ভা বঙ্গবন্ধুর মা সায়েরা খাতুন কে।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন সায়েরা খাতুনের ছয় সন্তানের মধ্যে তৃতীয়। তিনি বংশের বড় ছেলে। বাবা-মায়ের কাছে তাঁর আদরের নাম ছিল খোকা। সন্তান যতই বয়সে বড় হোক কিংবা কর্মে বড় হোক, সন্তান সবসময় ছোটই থাকে মা-বাবার কাছে। বঙ্গবন্ধু বাবা-মায়ের চোখে আজীবন ছিলেন বড় খোকা। এমনকি বঙ্গবন্ধু যখন রাষ্ট্রপতি, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি তখনও তিনি তাঁদের কাছে বড় খোকাই রয়ে গেছেন। বঙ্গবন্ধু স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘‘আমার ওপর আমার মা-বাবার টান যে কত বেশি সে কথা কখনও বোঝাতে পারব না। তাঁরা আমাকে ‘খোকা’ বলে ডাকেন। মনে হয় আজো আমি তাঁদের ছোট্ট খোকাটি। পারলে কোলে করেই শুয়ে থাকে। এই বয়সেও আমি আমার মা-বাবার গলা ধরে আদর করি।’’
এক ভিডিও সাক্ষাৎকারে সায়েরা খাতুন বঙ্গবন্ধুর শৈশব সম্পর্কে বলেছেন, ‘এমন কিছু সে করেনি যা ভাল নয়। আমার বংশে তিনপুরুষেও এমন নির্ভীক সৎ, সাহসী ছেলে আসেনি।’
বঙ্গবন্ধুর শৈশবের পুরোটাই তাঁর মাকে ঘিরে। তিনি প্রায় গরিব সহপাঠীদের তাঁদের বাড়িতে নিয়ে আসতেন। মাকে বলে তাদেরকে ঘরে খাবার খাওয়াতেন। সায়েরা খাতুনও তাতে কখনো আপত্তি করেননি। বরং ছেলের উদারতায় মুগ্ধ হতেন তিনি। একবার শেখ মুজিব তাঁর ছাতাটা এক বন্ধুকে দিয়ে নিজে বৃষ্টিতে ভিজে বাড়ি ফিরলেন। মা ভেবেছেন, খোকা হয়তো ছাতা হারিয়ে ফেলেছে। আরেকদিন গায়ের চাদরও দিয়ে এসেছেন অসহায় আরেকজনকে। শিশু মুজিবের এই উদারতায় হাসতেন সায়েরা খাতুন। খোকাকে আদরে জড়িয়ে ধরতেন বুকে। মায়ের এই প্রশ্রয়েই বঙ্গবন্ধু শিখেছেন মানুষের প্রতি ভালবাসা।
বঙ্গবন্ধু মা সম্পর্কে লিখেছেন ‘আম্মা? তিনি দয়ালু, ধার্মিক। তাঁর নিজের জগৎ নিয়েই তিনি থাকেন।’ সায়েরা খাতুনের নিজের জগৎ বলতে তাঁর স্বামী-সন্তান এবং সংসার। স্বামী-সংসার এর চিন্তাই ছিল তাঁর প্রধান কাজ। তিনি শহরকে পছন্দ করতেন না, সেকারণে গ্রামেই থাকতেন। ‘‘তিনি কোনদিন আমার আব্বার সঙ্গে শহরে থাকতেন না। তিনি সমস্ত সম্পত্তি দেখাশোনা করতেন আর বলতেন, ‘আমার আব্বা আমাকে সম্পত্তি দিয়ে গেছেন। যাতে তাঁর বাড়িতে আমি থাকি। শহরে চলে গেলে এ বাড়িতে আলো জ্বলবে না, বাবা অভিশাপ দিবে।” তিনি তাঁর পুরো জীবন গ্রামে কাটিয়েছেন। তবে বঙ্গবন্ধু যখন কারাবন্দী থাকতেন দেশের বিভিন্ন স্থানে, শেখ লুৎফর রহমানের সাথে তিনিও সেখানে যেতেন তাঁর প্রাণপ্রিয় পুত্রকে দেখতে।
বঙ্গবন্ধুর মত বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকেও সায়েরা খাতুন অন্য সন্তানদের সাথে বড় করেছেন। কারন বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী বিয়ের সময় অনেক ছোট ছিলেন ।
দৃঢ় শক্তিশালী মনোবলের অধিকারী ছিলেন সায়রা খাতুন। তার বড় খোকা দিনের পর দিন বাংলার মানুষের জন্য সংগ্রাম করেছে, জেলে যাচ্ছে এবং পাকিস্তান সরকারের নির্যাতন সহ্য করছে তবু মা সায়েরা খাতুন সন্তানকে কখনো পিছু হটতে বলেননি। কখনো বলেননি রাজনীতি ছাড়ার কথা। হাজারো নির্যাতনে মানুষের অধিকারের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু যেমন ছিলেন অবিচল, মা হয়ে সায়েরা খাতুনও মনে শঙ্কা থাকলেও অবিচল থাকতেন। অনেকটা ‘মাক্সিম গোর্কির মাদার’ চরিত্রটির সাথে মিলে যায়।
সায়েরা খাতুন বঙ্গবন্ধুকে একবার বলেছেন, ‘বাবা, তুই তো পাকিস্তান পাকিস্তান করে চিৎকার করেছিস, কত টাকা খরচ করেছিস, এ দেশের মানুষ তো তোর থেকেই পাকিস্তানের নাম শুনেছিল, আজ তোকেই সেই পাকিস্তানের জেলে কেন নেয়?’ আদরের বড় খোকার কারাবন্দি জীবন মা সহ্য করতে পারতেন না। বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র ১৮৭ নং পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘রাতে আবার থানায় রইলাম।....মা অনেক কেঁদেছিল, খবর পেলাম। আমার মনটাও খারাপ হল। আমার মা, আব্বা ও ভাইবোন এবং ছেলেমেয়েদের এ দুঃখ না দিলেই পারত।’ ১৯০ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘সকলেই আমার শরীরের অবস্থা দেখে চিন্তাযুক্ত হয়ে পড়েছিল। মা তো চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলেন।’ এই গ্রন্থের ১৮৩ নং পৃষ্ঠায়ও মা সায়েরা খাতুনের কান্নার উল্লেখ আছে। ছেলের জেলজীবন দেখে তিনি কাঁদতেন, অথচ শেখ মুজিবকে তিনি রাজনীতি ছাড়তে বলেননি। সায়েরা খাতুন তাঁর সন্তানকে বাংলার মানুষের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যেও বাবা-মায়ের মুখটি ভুলতেন না। ‘কারাগারের রোজনামচা’য় ৬৩ নং পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন, ‘‘মনে পড়ল আমার বৃদ্ধ বাবা-মার কথা। বেরিয়ে কি তাঁদের দেখতে পাব? তাঁদের শরীরও ভাল না। বাবা বুড়া হয়ে গেছেন। তাঁদের পক্ষে আমাকে দেখতে আসা খুবই কষ্টকর। খোদার কাছে বললাম, ‘‘খোদা তুমি তাদের বাঁচিয়ে রেখ, সুস্থ রেখ।’’
বঙ্গবন্ধু জাতির জনক হয়েছেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। তার মা তখন বেঁচে ছিলেন, অথচ কি সাধারণ সাদামাটাভাবে টুঙ্গিপাড়াতেই জীবনযাপন করে গেছেন।পৃথিবীর আর কোন দেশের রাষ্ট্রপতির মা বা পরিবারের লোকজন এত সাধারণ জীবনযাপন করেছেন কিনা তা আমাদের জানা নেই।
১৯৭৫ সালের ৩১ মার্চ এই মহিয়সী নারী পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। স্বামী শেখ লুৎফর রহমান তাঁর মাত্র একদিন পূর্বেই পরলোকে পাড়ি দেন। তাঁদের দুজনকেই টুঙ্গিপাড়ায় সমাহিত করা হয়। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতাবিরোধী বিপথগামী ঘাতকদের হাতে নিহত হন। বঙ্গবন্ধুকেও টুঙ্গিপাড়ায় সমাহিত করা হয় তাঁর বাবা-মায়ের কবরের পাশে। কয়েকদিন পূর্বে সায়েরা খাতুনের মৃত্যুবার্ষিকী পালন করেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
এক সর্বংসহা মা সায়েরা খাতুন। তিনি ছিলেন বলেই আমরা বঙ্গবন্ধু কে পেয়েছি। ভীষণভাবে সাধারণ হয়েও অসাধারণ এই মহিয়ষী নারী সম্পর্কে আমরা নিজেরা যেমন জানবো এবং তেমনিভাবে নতুন প্রজন্মকেও জানাবো। এই আহবান করি।
‘‘মা তুমি অন্তহীন শ্রদ্ধা, সম্মান আর চিরভক্তির স্থানে ছিলে, তেমনি আজীবন থাকবে। এই বাংলার আকাশ বাতাস প্রতিটি ধুলিকনায় যতদিন বঙ্গবন্ধু থাকবে ততদিন তুমিও থাকবে অমলিন হয়ে। কারন তুমি যে বীর প্রসবিনী।’’
জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশ চিরজিবী হোক।
বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংসদ ও বঙ্গবন্ধু স্মৃতি পাঠাগার ছাত্র ফেডারেশন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে সহ-সম্পাদক রায়হান জামিল ভূঁইয়া বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রত্নগর্ভা মা এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দাদী সায়েরা খাতুনের ৪৫তম মৃত্যুবার্ষিকী।
You cannot copy content of this page