আজ ২১ জুন। বিশ্ব বাবা দিবস। জুন মাসের তৃতীয় রোববার বিশ্বের প্রায় ৭৪টি দেশে বাবা দিবস পালিত হয়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯০৮ সালে প্রথম বাবা দিবস উদযাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। ১৯৬৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি জনসন জুন মাসের তৃতীয় রোববারকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাবা দিবস হিসেবে নির্ধারণ করেন। ১৯৭২ সালে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন প্রতিবছর জাতীয়ভাবে বাবা দিবস পালনের রীতি চালু করেন।
বাবাকে নিয়ে যদি লেখা শুরু করি, তাহলে কোথা থেকে যে শুরু করে কোথায় গিয়ে শেষ করবো তা বুঝে ওঠাই মুশকিল। পৃথিবীতে মানুষের শ্রেষ্ঠ আপনজনদের মধ্যে অন্যতম ব্যক্তি হলেন বাবা। তাকে কোনো একটি দিনে স্মরণ, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জানানো যথেষ্ট নয়। বরং প্রতিটি দিনই যেন আমাদের বাবা দিবস।
আস্থা, ভরসা আর পরম নির্ভরতার নাম বাবা। বাবা এমন এক বৃক্ষ, যে বৃক্ষের ছায়ায় আস্থার খোরাকে বেঁচে থাকার শক্তি পায় সন্তান। প্রতিটি সন্তানের কাছেই বাবা মানে শক্তি আর সাহস। বাবার প্রতি সন্তানের চিরন্তন ভালোবাসার প্রকাশ প্রতিদিনই ঘটে। এই ভালোবাসা বিশেষ কোনো একদিনের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকে না। বাবা-মার জন্য ভালোবাসা প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষণ। যদিও বাবা-মার জন্য বিশেষ দিন হিসেবে প্রতিবছর নির্দিষ্ট করে একটি দিন পালিত হয়ে আসছে। আসলে বাবা-মার জন্য ভালোবাসার কোনো নির্দিষ্ট দিন নেই।
বাবা মানে একটু শাসন, অনেক ভালোবাসা। প্রতিটি মানুষের জীবনে বাবা ছাদ হয়ে থাকেন। আমাদের বাবা আমাদের জন্য বটবৃক্ষের ছায়া। ছোটবেলায় বাবা যখন শাসন করতেন তখন খারাপ লাগতো কিন্তু এখন বুঝি বাবার সেই শাসন আমাদের জন্য কতটা প্রয়োজন ছিল। বাড়ির সামনেই বয়ে গেছে আঁকাবাঁকা করতোয়া নদী। ছোটবেলায় মন চাইত নদীতে গিয়ে ঝাপাঝাপি করি কিন্তু বাবা সবসময় বারণ করতেন, তাই যেতাম না। নদীতে গোসল করাতে যাওয়াটা বাবা ভয় পেতেন আর এ জন্যই ভয় পেতেন যে আমার না আবার কিছু হয়ে যায়। শরীর খারাপ করবে বলে বৃষ্টিতে কখনও ভিজতেও দিতেন না। বাবা যদিও বাইরে একটু কঠিন মনে হয় কিন্তু বাবার ভেতরটায় আমাদের জন্য নিখাঁদ ভালোবাসায় পূর্ণ আর তা সব সময়ই আমরা প্রত্যক্ষ করি।
আমার বাবা ৮-১০ টা বাবার মত শিক্ষিত নন। তেমন কোন বড় ফ্যামেলিরও না। সাধারণ একটি চাকুরী করে আমাদের সংসার চালায়। কোন রকমেই আল্লাহর রহমতে আমাদের পরিবার চলে। তবে বাবা সব সময় আমার দিকে সবচেয়ে বেশি খেয়ার রাখেন। ছোট বেলা থেকেই আমার মা আমাকে অনেক শাসনের মধ্যে বড় করেছেন । তবে বাবার পরম আদর পেয়েছি। আমার মনে আছে স্কুল , কলেজের ফিস মনে হয় সবার আগে আমিই দিতাম। বাবাকে বলার সাথে সাথে তিনি আমার ফিস দিয়ে দিতেন। আগেই বলেছি আমি মধ্যবৃত্ত পরিবারের ছেলে । তারপরেও বাবা মনে করতেন তার জীবনে ছেলের ফিসটা মনে দেওয়াটা খুব জরুরী। অনেক পরিবারে দেখেছি ছেলে মেয়ের কাছে বাবারা অভাব দেখাতো । কিন্তু আমি আজ পর্যন্ত বাবার কাছে কখনো অভাব জিনিসটি অনুভব করিনি। আমি ২০১৮ সালে ঢাকায় আসি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কোচিং এর জন্য। এর পর ২০১৯ সাল থেকে তিতুমীর কলেজে অনার্স করার সুবাধে ঢাকায় থাকা হচ্ছে। প্রতিমাসে ১০ হাজার টাকার উপরে খরচ থাকে আমার। যা আমার বাবার পক্ষে চালানো খুবই কষ্টকর। তারপরেও আজ পর্যন্ত ৫ তারিখের পর কোনদিন অতিক্রম করেনি। এর আগেই টাকা পাঠিয়ে দিতেন বাবা । মায়ের কাছে শুনেছিলাম কয়েক মাস নাকি হাওলাত করেও টাকা পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু বুঝতে দেয়নি বাবা। এটাই হয়তো বাবার বৈশিষ্ট্য। নিজের কাছে অনেক খারাফ লাগতো। অবশেষে এখন নিজের খরচ নিজে চালানো শিখেছি। তারপরেও বাবা কল দিয়ে বলে পকেটে টাকা আছেতো?
বাবার সাথে আমার অনেক স্মৃতি আছে। বাবা আমাকে আদর করতেন ঠিকই কিন্তু কখনও গায়ে হাত তোলেননি। আমার মনে পড়ে, আমার জীবনে একবারই বাবা আমার গায়ে হাত তুলেছিলেন। তখন আমি ৬ষ্ঠ কিংবা ৭ম শ্রেণিতে পড়ি। গ্রামের এক দুষ্ট প্রকৃতির ছেলের সাথে কথা কাটাকাটি হয়। যদিও তারই দোষ ছিল কিন্তু তার পক্ষ থেকে বাড়িতে বিচার আসে। এ বিষয়ে বাবা অনেক রাগ করেন এবং কঠোরভাবে আমাকে মেরেছিলেন। তখন মনে হলো বাবা আমার অনেক শত্রু। রাত তখন ১ টা আমি চোখ বুজে ঘুমানোর চেষ্টা করছি। হঠাৎ দেখি বাবা আমার রুমে। ভেবেছে আমি ঘুমিয়ে গেছি। পরে দেখি আমাকে যেখানে মেরেছে সেখানে একটু ফুলে গেছে। বাবা দেখলাম সেখানে তৈল লাগিয়ে মালিশ করে দিয়েছে। তখন সত্যি আমার সব রাগ যে কোথায় গেছে আমি নিজেও জানি না।
আসলে প্রতিটি বাবাই সন্তানের নির্ভরতার ছাদ। বাবা শাশ্বত, চিরন্তন। সন্তানের ভালোর জন্য জীবনের প্রায় সবকিছুই নির্দ্বিধায় ত্যাগ করতে হয় বাবাকে। আদর-শাসন আর বিশ্বস্ততার জায়গা হলো বাবা। বাবার মাধ্যমেই সন্তানের জীবনের শুরু। সন্তান বাবার ঋণ কখনও পরিমাপ করতেও পারে না।
সেদিন একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিও দেখছিলাম যে, আশি বছরের এক বৃদ্ধ বাবা রিকশা চালাচ্ছেন। ভিডিওটি দেখে আমার চোখ থেকে অশ্রু চলে আসে। সংসারের জন্য কত কষ্টই না করতে হয় একজন বাবাকে। আমরা অনেকেই হয়তো আমাদের পিতা-মাতার জন্য এতটা কষ্ট সহ্য করতে প্রস্তুত নই।
হাদিসে এসেছে মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তার নাক ধুলায় মলিন হোক, তার নাক ধুলায় মলিন হোক, তার নাক ধুলায় মলিন হোক, সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! সেই হতভাগ্য ব্যক্তিটি কে? রাসুলুল্লাহ তার নাক ধুলায় মলিন হোক এরশাদ করেন, সে হলো ওই ব্যক্তি, যে তার পিতা-মাতা উভয়কে অথবা একজনকে পেল অথচ তাদের সেবা করে জান্নাত হাসিল করতে পারলো না।’ (মুসলিম) মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম আরও বলেছেন, ‘আল্লাহর সন্তুষ্টি পিতার সন্তুষ্টিতে এবং আল্লাহর অসন্তুষ্টি পিতার অসন্তুষ্টিতে নিহিত।’ (তিরমিজি)।
আসলে বাবার ছায়া শেষ বিকেলের বটগাছের ছায়ার চাইতেও বড়। সে তার সন্তানকে জীবনের সব উত্তাপ থেকে সামলে রাখেন। দয়াময় প্রভুর দরবারে দোয়া করি, তিনি যেন আমাদের প্রিয় বাবা-মাকে দীর্ঘায়ু দান করেন এবং সুস্থ রাখেন। আসুন, আমরা আমাদের বাবা-মায়ের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করি আর আল্লাহ-তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন করি। আর সকলের প্রতি অনুরোধ বাবা মায়ের বয়ম হলে তাদের কোনদিন দূরে ঠেলে দিবেন না। মনে রাখবেন তাদের অবস্থানে আপনারাও একদিন যাবেন। তাদের সাথে আপনারা যেমন আচরণ করবেন ঠিক তেমনটাই আপনাদের জন্যও অপেক্ষা করবে। পরিশেষে একটা কথায় বলবো , বাবা তোমার জন্যই আজকের আমি। আল্লাহ তোমাকে সুস্থ রাখুক।
লেখক: সংবাদকর্মী, দৈনিক স্বদেশ প্রতিদিন
শিক্ষার্থী, সরকারি তিতুমীর কলেজ।
You cannot copy content of this page