মার্চ মাসের কথা, তখনও বাংলাদেশ করোনাভাইরাসে কেউ সংক্রমণ হয়নি। বলছি ঠিক কিভাবে গ্রামাঞ্চলের গন্ডি পেরিয়ে আমাদের করোনা স্কোয়াডের যাত্রা শুরু হলো এবং আমরা কিভাবে এই মহামারির সময়েও কাজ করে যাচ্ছি, সেই কথা। মার্চ মাসের শুরু থেকেই উদ্ভুত পরিস্থিতিতে মানুষের জন্য কাজ করার কথা ভাবছিলেন, লেখালেখিসহ নানা মাধ্যমে যোগাযোগ করছিলেন করোনা স্কোয়াড এর প্রতিষ্ঠাতা। তারপর একে একে সরাসরি মাঠে নামা।
সে সময় বাংলাদেশ সরকার কেবল ভাবছে সাধারণ ছুটির বিষয়ে, অথবা কানাঘুষা চলছে দেশ লকডাউন করে দিবে। ঠিক তেমন একটা সময়ে আমাদের যাত্রা শুরু।
আমাদের ঝিনাইদহ জেলার ভাটই গ্রামের শ্রদ্ধাভাজন বড় ভাই জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হীরক মুশফিক এর নেতৃত্বে শুরু হয় করোনা স্কোয়াড এর যাত্রা। তার নেতৃত্বেই এখনো আমরা কাজ করে চলেছি।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়াই ভাই বাড়িতে অবস্থান করছিলেন এবং আগেই বলেছি তিনি বেশ কিছুদিন ধরেই ভাবছিলেন, যদি খুব খারাপ সময় আমাদের সামনে আসে তার আগেই কিছু করা যায় কিনা!
বরাবরই হীরক ভাই সাধারণ মানুষের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা করে এবং খুব সহজেই তাদের সাথে মিশে তাদের সাথে বিভিন্ন আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান বা বিভিন্ন ভাবে পাশে থাকেন।
অন্যদের মতন তিনি বুঝতে পারছিলেন যে আমাদের জন্য খুব খারাপ সময় আসছে। কিভাবে মানুষের পাশে থাকা যায়? এমন একটা আহবান স্থানীয় যুবকদের মাঝে ফেসবুক পোস্ট এর মাঝে ছুঁড়ে দেন। সেখানে অনেকে তাদের সুপরামর্শ ও মতামত প্রকাশ করে আমিও আমার ক্ষুদ্র ধারণা থেকে কিছু কথা লিখি যেগুলো আমাদের গ্রামাঞ্চলে করা যেতে পারে, তারপরই যোগাযোগ। এরপর আরো কিছু স্থানীয় যুবক, যাদের নাম না বললেই নয় মনোজিৎ, কনক, বেনজির সহ আমাদের আরেকজন বড় ভাই, করোনা স্কোয়াড এর উপদেষ্টা মোস্তাফিজুর রহমান জুয়েল ভাইয়ের সাথে একটা প্রাথমিক আলোচনা হয়। কিভাবে কি করা যেতে পারে এই নিয়ে।
আমার মনে আছে আমাদের প্রথম মিটিংটা হয়েছিল অনলাইন মেসেঞ্জার গ্রুপে। আমরা যখনই ভাবলাম সবাই মিলে গ্রামের মানুষের জন্য কিছু করতে হবে তখনই একটা মেসেঞ্জার গ্রুপ খোলা হয় এলাকার যুবকেরা যে যেখানেই থাক না কেন, যাতে সবাই সবার মতামত ও সহযোগিতার মাধ্যমে কাজগুলো করতে পারি। আমাদের কার্যক্রমের শুরুটা হয় জনাকীর্ণ বাজারের প্রতি দোকানে ৩ ফুট দূরত্ব রেখে দাগ এঁকে দিতে হবে যেন সবাই শারিরীক দুরুত্ব বজায় রেখে কেনাকাটা করতে পারে। পরবর্তী ধাপে আমাদের গ্রামের প্রত্যেকটা পাড়া-মহল্লায় গিয়ে প্রতিটা ব্যবহারযোগ্য জায়গা বিশেষ করে মসজিদ, দোকান বা ভীড় হয় এমন জায়গাগুললোতে স্প্রে করি এবং সাবান দিয়ে হাত ধোবার জন্য সবাইকে উৎসাহিত করি। মসজিদ সহ প্রতিটা হাত ধোবার স্থানে এবং প্রয়োজনীয় জায়গায় আমার সাবান প্রদান করি।
বাজারে হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিতরণ, সচেতন কার্যক্রম চলছে। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসেন বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত এলাকার বেশ কিছু শিক্ষিত অগ্রজ। তারা সবাই আমাদের এই কাজটাকে খুব ইতিবাচক ভাবে দেখেন এবং আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করেন। অনেকে সেচ্ছাসেবক হিসেবে যুক্ত হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন, কেউ কেউ আবার দূরেও সরে যায়। সব মিলে এখনো যারা কাজ করছে তার মধ্যে শিমুল, মিলন, নাসিম, তিসান, মিশন সুমন ভাই সহ বেশ কিছু মানুষ রয়েছে যারা নিবেদিত প্রাণ।
তো শুরুর দিকে ওভাবে চলছিলো, ইতোমধ্যে দেশে করোনা ভাইরাস ধরা পড়েছে সবাই খুব ভয়ে আছে। কেউ বাড়ির বাইরে বের হচ্ছেনা সরকার বিভিন্ন স্থানে লক ডাউন ঘোষণা করে দিয়েছে এবং নানারকম সরকারি বিধি নিষেধ জারি হয়েছে। এমন সময় স্বাভাবিকভাবেই সবাই বাড়িতে অবস্থান করতে হচ্ছে, আমাদের গ্রামের নিম্ন আয়ের মানুষ জন বাড়ির বাইরে বেরোতে পারছেনা অর্থ উপার্জনের জন্য। খুব কষ্টে জীবন যাপন করতে থাকে এমন তথ্য আমাদের কাছে আসতে থাকে। আমরা নতুন করে সিদ্ধান্ত নেই যে, কীভাবে তাদের পাশে আমরা এই মুহুর্তে থাকতে পারি। সেই সাথে যে সকল মধ্যবিত্ত পরিবার শত কষ্টেও গোপন রাখে মান সম্মানের ভয়ে আমরা তাদের পাশে দাঁড়াতে সীদ্ধান্ত নিলাম। গোপন তথ্যের ভিত্তিতে গোপনে নগদ অর্থসহ খাদ্যদ্রব্য দেয়ার ব্যবস্থা করলেন হীরক মুশফিক ভাই ও জুয়েল ভাই।
আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এইসব মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই, কারণ ইতিহাসে যেকোনো ভালো কাজে আগে যুবকরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে। অনুপ্রেরণা পেয়েছি মুক্তিযুদ্ধের গল্প জেনে, ছোটবেলায় স্যারদের কথাগুলো আমাদেরকে শক্তি যুগিয়েছে এবং হীরক ভাই আমাদেরকে বিভিন্ন বিষয়ে বোঝাতেন এবং সাহস যোগাতেন। এরপরের মিটিংএ আলোচনা হয় যাদের ঘরে চাউল নাই তেল নাই,নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র নাই তাদের জন্য কি করা যায়! সেই জায়গা থেকে আলোচনায় উঠে আসে আমরা যদি যাদের অবস্থা একেবারেই খারাপ এদের দৈনন্দিন কাজে লাগে এমন কিছু খাবার দাবার ক্রয় করে প্যাকেট করে বাড়িতে সরবরাহ করি তাহলে এই সময়ে খুব উপকার হবে তাদের।
ইতোমধ্যে আমাদের কার্যক্রম ফেসবুকের মাধ্যমে দেখে গ্রামের কয়েকজন বড় ভাই বললেন, যদি কোন হেল্প প্রয়োজন হয় তারা করতে চান। নিজে থেকে যারা আগ্রহী হয়ে যারা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন আমরা তাদেরটা গ্রহণ করেছি। কিন্তু ভালো লাগার ব্যাপার আজকে পর্যন্ত আমাদের কারো কাছে হাত পাততে হয়নি বা চাঁদা চাইতে হয়নি। যখন কোন না কোনভাবে ব্যবস্থা হয়েছে। আটকে গেলে প্রয়োজনে স্কোয়াড মেম্বাররা চাঁদা দিয়ে কাজটির শেষ নামিয়েছি।
যাই হোক, আমরা কেনাকাটা করে সুন্দর করে প্যাকেট করে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেয়া শুরু করলাম।উপহার সামগ্রী, নগদ অর্থ প্রদান ছাড়াও সম্মানিত প্রতিষ্ঠাতার নির্দেশে সেবার গাড়ির মাধ্যমে বিনামূল্যে গ্রামাঞ্চলে সবজি বিতরণ শুরু করি। সেবার গাড়ি কন্সেপ্টটি ভীষণ প্রশংসিত হয় দেশ জুড়ে। এর আগে নায্যমূল্যে বাড়ি বাড়ি সবজি বিক্রয় করেছি আমরা। চেষ্টা ছিলো বাইরে বেরিয়ে যাতে মানুষকে ঝুঁকিতে পড়েতে না হয়। আমরা এখনো প্রতিনিয়ত হ্যান্ড মাইকের মাধ্যমে সচেতন করে আসছি। চিকিৎসা সেবা লাগলে অভিজ্ঞ ডাক্তারের সাথে ফোনকলের মাধ্যমে বিনামূল্যে প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে আমরা করোনা স্কোয়াড কাজ করেছি এবং এখনো করে যাচ্ছি। এব্যপারে কয়েকজন দায়িত্বশীল ডাক্তার সব সময়ের জন্য আমাদের সাথে আছেন। উল্লেখ করতে চাই ঝিনাইদহের সন্তান সম্মানিত ড. জাহিদুল ইসলাম, ড. প্রসেনজিৎ বিশ্বাস পার্থ এবং ড. লিমন পারভেজ এই তিনজনের নাম।
করোনা স্কোয়াড প্রতিষ্ঠাতার সাথে সমন্বয় সাপেক্ষে, করোনা স্কোয়াড এর সাথে এলাকার মানুষের জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবার মতো মহান কাজটি করে চলেছেন তারা। কৃতজ্ঞতা জানাই। এমন মানুষ আরো আছেন আমাদের সাথে। অনেকে নাম প্রকাশ করতে চাননা। আমার ডায়েরিতে নিশ্চয়ই এইসব নাম লেখা থাকবে আজীবন।
আমাদের আরো একটি বিশেষ কর্মপ্রক্রিয়া সম্পর্কে অনেকেই হয়তো জানেন এখন। সেটি হচ্ছে করোনাট্য। মানুষকে সচেতন করার জন্য প্রত্যন্ত অঞ্চলে চলে যাই আমরা। করোনাট্য প্রদর্শনের মাধ্যমে স্বাস্থ্যবিধি মেনে, মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করি যে, এই মুহূর্তে সচেতন হওয়া ছাড়া আমাদের অন্য কোন উপায় নেই।
যেকোনো ভালো কাজেই অনেক প্রতিবন্ধকতা থাকে, আমরাও মাঝে মাঝে অনেক প্রতিকূল মুহূর্ত পার করেছি, করছি। কিন্তু থেমে যাইনি এমন সময় এসেছে যে আমাদের মানুষের হেল্প করার মত অর্থ নাই তখন নিজেরাই পকেট খরচের টাকা বাঁচিয়ে চেষ্টা করেছি মানুষের পাশে থাকার। কখনো কখনো দেখতে হয়, কেউ কেউ আমাদের কাজটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করছে। বিভিন্ন ভাবে সেগুলোও আমাদের কানে আসে কিন্তু আমরা করোনা স্কোয়াড বিশ্বাস করি “মানুষ মানুষের জন্য” ফলে এসবে পাত্তা দেইনি। মাঝে মাঝে ভালো লাগে যারা কেউ কেউ শুরুতে আমাদের উপহাস করতো আজ তারাই আবার আমাদেরকে শুভকামনা জানায়। কেউ আবার সহযোগিতা করার জন্য তার বাড়ির পাশের প্রতিবেশির নাম আমাদের কাছে দিয়ে যায়। আমরা খুবই খুশী হই তাদের পাশে থাকার জন্য এবং চেষ্টা করি সবার পাশে থাকার।
মাঝে মাঝে আফসোসও লাগে শহরকেন্দ্রিক যে তোড়জোড় চলে প্রতিনিয়ত, তার ছিটেফোঁটাও নজর যদি আমাদের দিকে পড়তো তবে হয়তো আরো ভালোভাবে আমরা মানুষকে সেবা দিতে পারতাম! আমরা হতাশদের দলে নই, সবমানুষের ভালোবাসা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি বলে এখনো মানুষ আমাদের জন্য আশীর্বাদ করে ডেকে বলে “বাবা তোমাদের সহযোগিতা অল্প হলেও অন্তত কয়েকদিন তোমাদের কারণে খাবারের চিন্তামুক্ত ছিলাম” এর থেকে আর কি পাওয়া হতে পারে একজন স্বেচ্ছাসেবকের? এভাবেই এগিয়ে যেতে চাই। আশা করি সবার ভালোবাসা নিয়ে নিশ্চয়ই আমরা মহামারি জয় করতে পারবো। ভালোবাসা করোনা স্কোয়াড।
Leave a Reply