করোনার সময় এখন পুরুষরা ঘরে থাকছেন। পরিবারের সব সদস্যরা ঘরে থাকছেন। ফলে নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়েছে। বিশ্বে এই করোনার সময় লকডাউনে নারী নির্যাতন ২০ শতাংশ বেড়েছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। আর এখানে স্বাভাবিক অবস্থায়ও নারীর প্রতি সহিংসতা বেশি। পৃথিবীর এমন দ্রঃসময়ে সমন্বয় হীনতা চরম অবক্ষয় ডেকে আনতে পারে গোটা সমাজের। ঝুঁকির মধ্যে পড়বে নারী কিশোর সহ পুরো পরিবার। এদিকে মুত্যুঝুকির মতো ঘটনাও ঘটতে পারে।করোনাকালের নারীদের নির্যাতনের জরিপ হিসেবে বেশকিছু ঘটনা ও তথ্যাদি উল্লেখ করা যায়।
রাজশাহীর পুঠিয়ায় দুলাভাইয়ের কাছে ধর্ষণের শিকার হয়েছিল ষষ্ঠ শ্রেণীর শিক্ষার্থী ইভা খাতুন। লজ্জা ও অভিমানে ইভার আত্মহত্যা করার দুই মাস পেরিয়ে গেলেও আসামিদের গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ। অবশেষে বিচারের আশায় গত বুধবার মেয়ের ছবি আর ‘ধর্ষণ ও আত্মহত্যার প্ররোচনাকারীর গ্রেপ্তার ও ফাঁসি চাই’- ব্যানার নিয়ে উপজেলা পরিষদের সামনে একাই দাঁড়িয়েছেন ইভার বাবা ভ্যানচালক সেলিম হোসেন।
অর্থনৈতিক টানাপোড়েন, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে হতাশা ও অস্থিরতাবোধ করায় পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সহিংস আচরণের ঘটনা ঘটছে।
নারী ও কন্যাশিশুর ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সবচেয়ে বেশি। নারী ও কন্যাশিশু শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। ধর্ষণ, শিশু ধর্ষণ, বাল্যবিবাহ, বৈবাহিক ধর্ষণ, বিবাহ-বিচ্ছেদ ও নারী পাচারের ঘটনা ঘটছে।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর অর্পিতা দাস দেশের বহুল প্রচলিত এক গনমাধ্যমে বলেন, ‘‘আমরা এক হাজার ৬৭২ জন নারীকে পেয়েছি যারা আগে কখনো নির্যাতনের শিকার হননি৷ এটা প্রমাণ করে যে লকডাউনের মধ্যে নির্যাতন বাড়ছে৷ আর এই নির্যাতনে স্বামীরাই প্রধানত জড়িত৷ কারণ তাদের কোনো কাজ নেই৷ অধিকাংশের আয় নাই৷ খাবার নেই৷ তারা বাইরে যেতে পারছেনা, আড্ডা দিতে পারছে না৷ এই সবকিছুর জন্য তারা আবার নারীকেই দায়ী করছে৷ নারীকে দায়ী করার এই মানসিকতার পিছনে নির্যাতনের প্রচলিত মানসিকতাই কাজ করছে৷ এর বাইরে শ্বশুর শাশুড়ি এবং পরিবারের অন্য সদস্যদেরও ভূমিকা আছে৷’’
লকডাউনের মধ্যে বাল্যবিবাহের কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘প্রথমত করোনার কারণে মানুষের দারিদ্র্য বেড়েছে৷ তাই অভিভাবকেরা বিয়ে দিয়ে দারিদ্র্য থেকে বাঁচার হয়তো একটা পথ খুঁজছেন৷ আর এই সময়ে বাল্য বিবাহ বিরোধী প্রচার এবং তৎপরতা কমে যাওয়ায় এটাকে কেউ কেউ সুযোগ হিসেবে নিয়েছে৷’’
পরিবর্তিত সময়ে বেকারত্ব ও হতাশা বাড়ায় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন, অর্থনৈতিক নির্যাতন, ধর্ষণের পর হত্যার মতো নৃশংস ঘটনাগুলো বাড়ছে। দীর্ঘদিনের সমাজ ব্যবস্থায় নারীর ওপর নিপীড়ন চেপে যাওয়ার স্বভাব, বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে অপরাধী সহজেই অপরাধ করার সাহস পায়।
ইউকের বিখ্যাত সংবাদপত্র দ্য গার্ডিয়ানের তথ্যমতে, লকডাউনের কারণে ইংল্যান্ডে নারী নির্যাতন, শিশু নিপীড়ন ও পারিবারিক সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে । অপরদিকে ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্তোফে কাস্তাঁয়ের জানিয়েছেন, লকডাউনের পর ফ্রান্সের বেশ কয়েকটি পুলিশ স্টেশনে পারিবারিক সহিংসতার অভিযোগের হার ৩০ শতাংশ বেড়েছে। জাতিসংঘ বলেছে, তুলনামূলকভাবে দরিদ্র ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোয় ঘরে যারা নিপীড়নের শিকার হন, তাদের ক্ষেত্রেও পারিবারিক সহিংসতা বৃদ্ধি পেতে পারে।
আমরা যদি বাংলাদেশের দিকে তাকাই, বাংলাদেশে করোনাকালে নারী নির্যাতনের পরিধি ও ধরণ জানতে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর পর্যালোচনা করে রীতিমতো উদ্বেগজনক পরিস্থিতি পাওয়া গেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা মানবধিকার সংস্থা থেকে এখনও সেরকম রিপোর্ট বা তথ্য পাওয়া যায়নি। তাই গত মার্চ ২০ থেকে এপ্রিল ২০ পর্যন্ত মোটামুটি ৫টি দৈনিক পত্রিকার রিপোর্ট পর্যালোচনা করে যে ঘটনাগুলো বেশি পাওয়া গেছে তার মধ্যে ধর্ষণ, যৌতুকের দাবিতে নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন, গৃহকর্মী নির্যাতন এবং আত্মহত্যা উল্লেখযোগ্য। তুলনামূলকভাবে ধর্ষণের পরিমান সবচেয়ে বেশি এবং ৮০% ক্ষেত্রে ভিকটিম শিশু। পাশাপাশি ৪ এপ্রিল দৈনিক প্রথম আলোর সূত্রমতে, ঢাকা মহানগর এলাকায় ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত মাত্র ১০ দিনে ধর্ষণ, যৌতুকের দাবিতে নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন ও অপহরণের ২৮টি মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন ৩৭ জন। এই সময়ের মধ্যে ৯টি ধর্ষণের মামলা হয়েছে। আর যৌতুকের জন্য নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৮টি। এর বাইরে যৌন নিপীড়নের অপরাধে মামলা হয়েছে ৬টি, অপহরণের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৫টি।
কাদের দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছে নারী এই সময়ে?
সংবাদপত্রের খবর পর্যালোচনা করে দেখা যায়- স্বামী, প্রতিবেশী, ৬০ উর্ধ্ব বৃদ্ধ কিংবা পথচারী এমনকি সহপাঠীদের দ্বারা সহিংসতার শিকার হয়েছে নারী। কোথায় বেশি ঘটেছে নারী নির্যাতন? পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গ্রামকেন্দ্রিক ঘটনা বেশি হলেও মফস্বল শহরে পৌরসভার ভেতরেও নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। শ্রেণীগত দিক থেকে কারা ভিকটিমাইজড হচ্ছে অর্থাৎ ভিকটিমের শ্রেণীভিত্তিক পরিচয়টা কি? এক্ষেত্রে বেশিরভাগ রিপোর্ট এ উল্লেখ না থাকলেও বোঝা যাচ্ছে, নিম্ন মধ্যবিত্ত কিংবা দরিদ্র শ্রেণির নারীরা বেশি সহিংসতার শিকার হয়েছেন। যেমন- গার্মেন্টস কর্মী, গৃহপরিচারিকা, শিশু, প্রান্তিক নারী।
আত্নহত্যার ঘটনার কারণ হসাবে দেখা যায়, ধর্ষণ চেষ্টা কিংবা উত্যক্ত করায় আত্মহত্যা, শ্বাশুড়ির সাথে ঝগড়ায় আত্মহত্যা, একটা ব্যতিক্রমী ঘটনা যেটা না বললেই নয়, খাবারের অভাবে ১০ বছরের শিশুর আত্মহত্যার মতো ঘটনা। যৌতুকের দাবিতে নিপীড়ন এবং স্বামী কর্তৃক হত্যার মতো ঘটনাও ঘটতে দেখা যায়।
তবে নারী নির্যাতনের এই চিত্র বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। গত বছরে ২০১৯ সালের নারী নির্যাতনের চিত্র উঠে আসে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের লিগ্যাল এইড উপ-পরিষদের রিপোর্টে। ১৪টি দৈনিক পত্রিকা সংবাদ বিশ্লেষণ করে রিপোর্টে জানায়, গতবছরে ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয় ৪ হাজার ৬২২ জন নারী ও শিশু। বাল্যবিবাহের ঘটনাও ঘটেছে ৯৭টি ও বাল্যবিবাহ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে ১৬৯ জনকে।
এমতাবস্থায়, করোনাসহ বিভিন্ন মহামারিতে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার কারণ হিসাবে আমি নিম্নোক্ত বিষয়গুলো চিহ্নিত করেছি। প্রথমত, অর্থনৈতিক দুরাবস্থা ও দারিদ্র্যতার কারণে সৃষ্ট চাপ, কোয়ারেন্টিনে থাকার ফলে সামাজিক দূরত্ব, চিরাচরিত পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা, পারিপার্শ্বিক আর্থ সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের ফলে নীপিড়নমূলক আচারণ, রিপোর্ট করার সুযোগ না পাওয়া।
অর্থনৈতিক সঙ্কট ও দারিদ্রতার কারণে সৃষ্ট চাপের ফলে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা ও নিপীড়নমূলক আচরণ বৃদ্ধি পেতে পারে। লকডাউনে থাকার ফলে পুরুষ প্রচণ্ড অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। দেশ-বিদেশের চিত্র অনুসারে এই মহামারি চলাকালীন ইতিমধ্য কোটি কোটি মানুষ তাদের চাকরি হারিয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই চিত্র দেখা গেছে। উন্নয়নশীল দেশের সামাজিক রীতি অনুসারে সংসারের অর্থনৈতিক চালিকা পুরুষের কাঁধেই বর্তায়। চাকরি হারিয়ে এবং কর্মসংস্থানের স্থান বন্ধ থাকায় বেশিরভাগ পুরুষই প্রচণ্ড অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়েছে। অনেকেই ধার-দেনাসহ বিভিন্নভাবে সংসার চালোনোর চেষ্টা করেছে। এই অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে মানুষের মনে জন্ম নেয় হতাশা এবং মানসিক অবসাদ। এর ফলে অনেক ক্ষেত্রেই পুরুষ মেজাজ হারিয়ে নারীর প্রতি নির্যাতন করে। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত পরিবারে যাদের মধ্য অর্থনৈতিক সঙ্কট প্রকট, সেইসব পরিবারে এই সহিংসতার পরিমান বেশি।
স্নাইডার ও তার সহলেখকগণ ২০১৬ সালে আমেরিকায় বিশ্ব মন্দার সময় তাদের গবেষণায় দেখান যে, চাকরিহীন পুরুষ দ্বারা তার সঙ্গীনীকে নির্যাতনের হার কর্মসংস্থানে থাকা পুরুষের কয়েক গুণ বেশি। পাশাপাশি বেলোত্রা, ২০১৯ সালে প্রকাশিত বিশ্বের ৩১টি দেশের উপর পরিচালিত এক গবেষণায় দেখান, বিশ্বমন্দায় পুরুষের বেকারত্বের কারণে নারী নির্যাতনের হার ২.৫% বেড়েছিল। অপরদিকে ঐ সময়ে নারীর দ্বারা পুরুষের প্রতি সহিংস আচরণ ২.৭৫% কমে গিয়েছিল।
কোয়ারেন্টিনে থাকার ফলে সামাজিক দূরত্ব বৃদ্ধির ফলে নারী নির্যাতন বৃদ্ধি পায়। বস্তুত আমরা অনেকেই ধারণা করে থাকি যেহেতু দৈনন্দিন ব্যাস্ততার কারণে দাম্পত্য জীবনে সময় দেওয়ার সুযোগ পায় না বেশিরভাগ পুরুষ; সেখানে এই কোয়ারেন্টিনের ফলে হয়তো দাম্পত্য সম্পর্ক ও পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় হবে।
কিন্তু বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে মহামারিসহ আপদকালীন সময়ে মানুষের মধ্য ভয়, আতঙ্ক, মানসিক চাপ, অবসাদ, দুঃশ্চিন্তা, নিদ্রাহীনতা বৃদ্ধি পায় এবং পারিবারিক সম্পর্কের ওপর তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এছাড়া এই সময় সামাজিক দূরত্বে থাকার ফলে মানুষ তার স্বাধীনতা হারায়, চিত্তবিনোদনের অভাববোধ করে; যার প্রভাব নারী-পুরুষের সম্পর্কেও নেতিবাচকভাবে পড়ে। উদাহরণস্বরুপ- লাউ ২০০৭ সালে হংকং এ পরিচালিত তার গবেষণায় দেখিয়েছেন সার্স, সোয়ান ফ্লু সংক্রমণের সময় বেশিরভাগ নির্যাতনকারী হোম কোয়ারেন্টিনে থাকায় সামাজিক দূরত্বের কারণে সৃষ্ট মানসিক চাপ থেকে নারীর ওপর নির্যাতন করেছেন বলে স্বীকার করেছেন।
এছাড়া লকডাউনের সময়ে যৌতুকের দাবিতেও নারীদের ওপর নির্যাতন বাড়ছে। ঘরে থাকা নারী ও শিশু যৌন নির্যাতনেরও শিকার হচ্ছে। আবার নির্যাতনের শিকার হয়েও অনেক ভুক্তভোগী ঘরের বাইরে যেতে পারছেন না। ফলে নির্যাতনের খবর পৌঁছায় না প্রশাসনের কাছে। এই বিষয়গুলো মাথায় রেখেই সমাধানের পথ তৈরি করতে হবে আমাদের। মাঠ প্রশাসনকে নারী ও শিশু নির্যাতন বিষয়ে সক্রিয় রাখা এবং করোনা পরিস্থিতিতে নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনাল ‘ভার্চুয়াল কোর্ট’-এর মাধ্যমে পরিচালনা করা যেতে পারে। পাশাপাশি নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে হটলাইন ১০৯ ও পুলিশি সহায়তার হটলাইন ৯৯৯ আরও কার্যকর ও সক্রিয় রাখা বিশেষ প্রয়োজন।
শিশুর প্রতি যৌন আচরণ, নির্যাতন শুধুমাত্র আমাদের দেশে হচ্ছে এমন নয়। বিষয়টি বিভিন্ন দেশে সংগঠিত হয়। তবে উন্নত দেশগুলোতে বিষয়টিকে সরকারিভাবে স্বীকার করে প্রতিরোধের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।
প্রশ্ন হচ্ছে এই ধরনের ঘটনা আগেও ঘটেছে বলে এখনও ঘটবে, অন্য দেশে হচ্ছে বলে আমাদের দেশে তা চলমান থাকবে; প্রতিবাদ প্রতিরোধ হবে না এবং সমাজ মেনে নিবে, নিশ্চয়ই এমনটা হতে পারে না।
বাংলাদেশের জনসংখ্যার হিসেব অনুসারে, শিশু ও যুব বয়সের জনসংখ্যা সবচেয়ে বেশি। তাই অগ্রহণযোগ্য ও বলপ্রয়োগে যৌন সম্পর্ক, নারীর মর্যাদা, শিশুর সাথে আচরণ সম্পর্কিত বিষয়ে পরিবার, সমাজ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনতে হবে।
লেখকঃ শিক্ষার্থী ও সংবাদকর্মী
Leave a Reply