বাংলার মাটিতে নারীদের দুর্দশার ইতিহাস বহু পুরনো। এই জমিন যৌন নিপীড়নের দুঃস্মৃতি বহন করে চলেছে হাজার বছর ধরে।
এই মাটিতে মারাঠা বর্গিদের নিপীড়ন কলঙ্কিত ইতিহাস হয়ে আছে। মগ ও পর্তৃগিজ দস্যুরাও বাংলায় হত্যা, ধর্ষণের কলঙ্ক রচনা করেছে। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনারা এদেশে অবাধে ধর্ষণ, হত্যার সঙ্গে ধর্ষণ করেছে। হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারীরাও মিয়ানমারের আরাকান থেকে ধর্ষণের বুকচাপা আর্তনাদ নিয়ে আমাদের দেশে আশ্রয় দিয়েছেন। কিন্তু এখন তো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এদেশে নেই। মারাঠা বার্গীরাও নেই, পর্তুগিজ দস্যুরাও নেই বা জমিদার প্রথা নেই। তবুও বাংলার মাটিতে ধর্ষকদের রাজত্ব!
একাত্তরে মা-বোনদের সেই আর্তনাদ কী চোখে ভাসে না ধর্ষকদের? অত্যাচারিদের বিতারিত করে নিজেরাই অত্যাচারি হয়ে পড়বে এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। বরং স্বাধীন দেশে বাঙালিরা কিছুতেই ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন সহ্য করবে না- এমনটা হওয়ার কথা ছিল। দুঃখজনক হলেও সত্য, সভ্য পৃথিবীতে স্বাধীন দেশে বসবাস করেও বারবার আর্তনাদে আকাশ ফাটাতে হয় নারীদের। কবে নিরাপত্তা মিলবে?
এখন কান পাতলেই শোনা যায় ধর্ষণের সংবাদ। সংবাদমাধ্যমে ধর্ষণ বা ধর্ষণের পর হত্যার খবরে সয়লাব। গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি সংবাদ সম্মেলন করে যে পরিসংখ্যানটা তুলে ধারল তা গা শিউরে ওঠার মতোন। তাদের হিসেবে চলতি বছরের জানুয়ারী থেকে বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৮৯২টি! এছাড়া ধর্ষণ চেষ্টার ঘটনা ঘটেছে ১৯২টি। ধর্ষণের শিকার হয়ে মারা গেছেন ৪১ জন। আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন ৯ জন ভুক্তভোগী।
এদিকে বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের হিসেব বলছে, গত বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছে এক হাজারেও বেশি শিশু। অর্থাৎ গড়ে দিনে তিনজন! এই পরিসংখ্যান স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য নিঃস্বন্দেহে বড় কলঙ্ক। যুদ্ধাবস্থাতেও হয়তো কোনো দেশে এতো ধর্ষণের ঘটনা ঘটে না। তাহলে বাংলার মাটিতে কাদের বিপক্ষে কাদের যুদ্ধ চলছে? এই আর্তনাদ থামবে কবে?
স্বাধীন দেশের নারীরা রাস্তায় বেরুলে ভেতরে চাপা আতঙ্ক কাজ করে। অভিভাবকরা চিন্তায় থাকে। এই বুঝি আজ তার পালা! খিদে মিটানোর জন্য তাকেই বুঝি অনুসরন করছে কেউ! মনে হওয়াটা স্বাভাবিক নয়-কি? সিলেটে স্বামীর সঙ্গে ঘুরতে বেড়িয়েছিলেন স্ত্রী, নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারেননি। স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে পালাক্রমে ধর্ষণ করেছেন একদল মানুষরুপী হায়েনা। চট্টগ্রামে মা-বাবার সামনে ৯ বাঙালি মিলে ধর্ষণ করল এক পাহাড়ি নারীকে। যশোরের সালতা গ্রামের বাক-প্রতিবন্ধী এক তরুণীও ধর্ষণের হাত থেকে বাঁচতে পারেননি। গাজীপুরে কৌশলে দুই তরুণীকে ধর্ষণ করেছে এক যুবক। অভিযোগ উঠছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের নামে, বৃদ্ধদের নামে, মসজিদের ইমামের নামেও। সমাজ যেন ধর্ষকে ছয়লাব!
স্ত্রী তার স্বামীর সাথে বের হয়েও যেখানে নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারলেন না সেখানে যাদের একা বাড়ি থেকে বেরুতে হয় তারা কিভাবে নিরাপদবোধ করবেন? এটা নিছক মজা ছাড়া আর কিছু নয়। সভ্য সমাজে সমান অধিকারের কথা বলে গলা ফাটানোর লোকের অভাব নেই। কিন্তু সমান অধিকারের আলোচনার ভীড়ে নারীদের নিরাপত্তা কোথায়।
এই সমাজ ব্যবস্থায় ধর্ষণের শিকার নারীকে তাচ্ছিল্যও সইতে হয়। পোশাক নিয়ে কথা উঠে। কিন্তু পোশাকই যদি ধর্ষণে উদ্বুদ্ধ করে তাহলে পাঁচ বছর বা দুই বছরের শিশুকেও কেন ধর্ষণের শিকার হতে হয়? ওই বয়সের মেয়ে শিশুরাও কী পোশাকে, শারীরীক গড়নে ধর্ষণে উদ্বুদ্ধ করে?
এই সমাজ ব্যবস্থা নারীদের সমান অধিকার দিয়েছে। শিক্ষা, কর্মস্থানসহ বিভিন্ন স্থানে নারীদের অধিকার তরান্নিত করেছে। কিন্তু এতে করে নারীদের যে পরিমান নিরাপত্তা প্রয়োজন তা কী দিতে পেরেছে। এই সমাজে নারীদের অধিকার নিয়ে কথা হয়, এই সমাজেই আবার নারীরা রাস্তায় রাস্তায় ধর্ষিত হয়। একই সমাজে দুই চিত্র সত্যি বড্ড বেমানান।
আমাদের বিবেকবোধ কোথায়? নারী জন্ম দিয়েছে, পৃথিবীর আলো দেখিয়েছে। পরে কিনা তারাই নারীর পৃথিবী অন্ধকার করে দিচ্ছে!
সব শেষে বলব, নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করুণ, অধিকারের চিন্তা পরেও করা যাবে।
লেখকঃ শিক্ষার্থী, সরকারি তিতুমীর কলেজ।
You cannot copy content of this page