সেদিন মামাতো বোন সাথী (ছদ্মনাম) হঠাৎ এসে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠেছিল। ‘কী হয়ে বল আমাকে’- কয়েকবার জিজ্ঞেস করার পর ফুফিয়ে ফুফিয়ে বলছিল, আপু আমি এই বিয়ে করতে চাই না। তুমি বাবাকে বুঝাও, আমাকে বাঁচাও। আমি পড়াশুনা করতে চাই, নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। তারপর বিয়ে করব। আমি বাল্যবিবাহ করতে চাই না….।
সাথী তখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। বয়স কতোই আর হবে, ১৫’র আশেপাশে হয়তো। এতোটুকু বয়সে বিয়ে! মামাকে বুঝানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করলাম। বাড়ির সবাইকে বুঝাতে চেয়েছি সেই সময়। রুখে দাঁড়াতে চেয়েছি, কিন্তু পারিনি। হয়তো এটা আমার সংকীর্ণতা! কয়েক দিন পর সাথীর বিয়ে হলো।
কাঁদতে কাঁদতে সেদিন শশুড়বাড়ি গেল মেয়েটা। তার পাঁচ দিনের মাথায় খবর এলো সাথী আর পৃথিবীতে নেই। গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে ফুলের মতো বোনটা আমার। খবরটা শুনে যেন পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গিয়েছিল আমার। বার বার কানে ভেসে আসছিল সাথীর আকুতি, আপু আমি মরে গেলেও বিয়ে করব না। বাল্যবিবাহের কারণে আমার চোখের সামনে ফুটফুটে বোনটার পরিনতি দেখেছি। এমন আরও হাজার হাজার সাথী আমাদের চোখের আড়ালে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিনিয়ত নিশ্বেস হচ্ছে। এই চিত্রের পরিবর্তন দরকার। দেশের আইন ব্যবস্থাকে সঠিক ভাবে বাস্তবায়ন করা দরকার।
দেশের মানুষকে সচেতন করতে আইন ব্যবস্থা আরও মজবুত করতে হবে। বাল্যবিবাহের জন্য যেন কোন মেয়ের জীবন অন্ধকারে নিমজ্জিত না হয়, সেজন্য পদক্ষেপ নেওয়া অতিব জরুরি। অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে বাবা মা নিশ্চিন্ত হতে চায়। পুতুল খেলার বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিয়ে অন্য পরিবারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এতে যেমন সংসার সাজানো সম্ভব হয় না, তেমনি সুন্দর ক্যারিয়ারের সম্ভাবনাও নষ্ট হয়। একাকিত্ব কাটাতে, পরিবারের দাবি মেটাতে বা নিজের একটা খেলার সাথি জোগাতে অল্প বয়সে সন্তান জন্মদানের সিদ্ধান্ত নেয়। অল্প বয়সে সন্তান জন্মদানের ফলে যেমন মা ও শিশুর মৃত্যুঝুঁকি বাড়ে, অন্যদিকে সামাজিক প্রতিবন্ধকতাও তৈরি হয়।
আমাদের সমাজ জীবন প্রতিনিয়ত সমস্যাগ্রস্ত। বাংলাদেশের গ্রাম ও শহরে বিভিন্ন সমস্যা বিরাজমান। এ সমস্যাগুলো নিরসনের কোনো সঠিক ব্যবস্থা না থাকায় এগুলো আরও জটিল রুপ ধারণ করছে। এসব সমস্যার মধ্যে বাল্যবিবাহ একটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা।
আমরা সাধারণত বাল্যবিবাহ বলতে অপ্রাপ্ত বয়স্ক বিবাহকেই বুঝি। বাংলাদেশে মেয়েদের নুন্যতম ১৮ এবং ছেলেদের ২১ বছর বয়সের আগে বিয়েকে বাল্যবিবাহ বলা হয়। বাল্যবিবাহ যেমন একটি ব্যক্তির জীবন দুর্বিসহ করে তোলে তার সাথে সাথে ব্যক্তির পরিবার,সমাজ ও দেশেরও মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে। বাল্যবিবাহ নিরসনে বাংলাদেশে আইন থাকলেও তা যথাযথ প্রয়োগী নেই। এজন্যই হয়তো দিনে দিনে এটি একটি মারাত্মক রূপ ধারণ করছে।
সমাজব্যবস্থারও দায় আছে এতে। মেয়ের বয়স একটু বাড়লেই পাড়াপড়শির মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে যায়। কেন বিয়ে হচ্ছে না এমন হাজারও মুখ বাকানো প্রশ্ন। আমি তখন নবম শ্রেণীতে পড়ি। কয়জন আমাকে নিয়ে গল্প করছিল। একজন বলছিল মেয়ে এতো বড় হয়ে গেছে বিয়ে দেওয়ার কোন চিন্তায় নেই তার বাবা-মার। আর একজন বলছিল, পড়াশুনা করে কি হবে এতো? একদিন তো সংসারই করতে হবে। তাদের কথা শুনে কিছুক্ষণ নিরবে চোখের পানি ফেলেছিলাম। আর মনকে প্রশ্ন করেছিলাম আমি কী এতোই বড় হলাম যে পাশের বাড়ির লোক দের ঘুম নষ্ট হয়েছে?
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রাম সূত্রে জানা গেছে, করোনাকালে এপ্রিল থেকে জুলাই মাসেই দেশে মোট ৩৩০টি বাল্যবিবাহ সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া মানুষের কল্যাণে ফাউন্ডেশনের (এমজেএফ) পক্ষ থেকে দেশের ৫৩টি জেলার মোট ৫৭ হাজার ৭০৪ নারী ও শিশুর জরিপ করে দেখা গেছে, চলতি বছরের শুধুমাত্র জুন মাসেই বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে ৪৬২ জন কন্যাশিশু। মে মাসের তুলনায় জুন মাসে বাল্যবিবাহের প্রায় তিন গুন বেড়েছে । মে মাসে বাল্যবিবাহে সংখ্যা ছিল ১৭০। অন্যদিকে কমে গেছে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের সংখ্যা।
গত মে মাসে ২৩৩টি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা গেলেও জুন মাসে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করা গেছে ২০৭টি। ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভারসিটি প্রগ্রাম সূত্রে জানা গেছে, দেশে যেসব এলাকায় ব্র্যাকের কার্যক্রম চলমান, সেখানে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত মোট ৩৩০টি বাল্যবিবাহের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ২২০টি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করে ব্র্যাক। এতথ্য থেকেই বুঝা যায় যে বাল্যবিবাহ বাংলাদেশে কতটা ভয়াবহ রুপ লাভ করেছে। বাল্যবিবাহ সত্যি আমাদের জীবন অভিশপ্ত করে তুলেছে।
মহামারী করোনাকালে দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছুটি থাকার ফলে এর প্রভাব পড়ছে শহর ছেড়ে গ্রাম চলে যাওয়া মেয়েদের উপর। অনেক বাবা মা তাদের বিয়ের কথা চিন্তা করছে এই সময়। মেয়েদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে দরিদ্র পরিবার গুলো। অনেক মেয়ের স্বপ্ন অকালে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নিজেদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে তারা বাল্যবিবাহ মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে।
সরকারের উচিত বাল্যবিবাহ বন্ধে কঠোর ভাবে আইন প্রয়োগ করা। যাতে কোন মেয়ের স্বপ্ন আর নষ্ট না হয়। সর্বোপরি প্রত্যেক কে সচেতন হতে হবে, বাল্যবিবাহকে না বলতে হবে।
লেখিকাঃ শিক্ষার্থী, সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা।
Leave a Reply