“অধিকার ছাড়িয়া দিয়া অধিকার ধরিয়া রাখার মতো বিড়ম্বনা আর হয় না” বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথার্থই বলিয়াছেন।
যেখানে মানুষই মানুষের অধিকার হরণের পেছনে পুরাদস্তুরভাবে লেগে আছে সেখানে যেকোনো দেশের সরকার কীভাবে সে মানবাধিকার সর্বাঙ্গীণভাবে নিশ্চিত করার বিষয়ে সুগম্ভীর থাকবে!
কথিত আছে মানুষ মানুষের জন্য। কিন্তু সত্যিকার অর্থেই কি মানুষ মানুষের জন্য হতে পেরেছে! মানুষের প্রতি মানুষের অমানবিক আচরণ বরাবরই খুব পরিষ্কার ফলে সমাজের অধঃপতনকে দেখার জন্য সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকানো অনাবশ্যক। মানবতা,মানসিকতার ইতিবাচকতা,মানবাধিকার একই জাতীয় বিষয়ে কথা বলতে গেলে তথাকথিত বিজ্ঞের অভাব হয় না কিন্তু এ সকল বিষয় বাস্তবায়নের কথা আসলেই দায়িত্বহীন ও কাপুরূষদের চেনা যায়। জন্মগতভাবে প্রতিটি মানুষের স্বাধীনভাবে চলার অধিকার,অন্যের সাহায্য লাভের অধিকার,নিজ ধর্ম পালনের অধিকার,নিরাপত্তা লাভের অধিকারের মতো কিছু অধিকার রয়েছে যা নিশ্চিতের দায়িত্ব শুধু রাষ্ট্রই নয় বরং সমাজের উপরও ন্যস্ত। একজন মানুষের চলাফেরার ক্ষেত্রে নিজেকে নিরাপদ ভাবার নিশ্চয়তা অন্য আরেকজন মানুষকেই দিতে হবে। যার যার ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে কোনরূপ হস্তক্ষেপ না পাওয়ার অধিকার অন্য মানুষদের দ্বারাই নিশ্চায়ন হতে হবে। অথচ নিরন্তর এর বিপরীতটাই হয়ে আসছে। প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে আধুনিকায়নের এই যুগেও মানুষেরাই মানুষের অধিকার হরণে খুবই দাম্ভিকতার সাথে কাজ করে আসছে। যেখানে মানুষ স্বাধীনভাবে চলার পক্ষে দাবি উত্থাপন করে সেখানে মানুষই আবার সেই স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্থ করে,যেখানে মানুষ ব্যক্তি নিরাপত্তার অধিকার চায় সেখানে মানুষই চুরি,ডাকাতি,ছিনতাই,হত্যা ইত্যাদির মতো অপকর্মে লিপ্ত। আর “ধর্ষণ” তো বর্তমানে যেনো পুরুষত্ব প্রকাশের একটি নতুন মাধ্যমে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। যেখানে মানুষ ধর্ম পালনে স্বাধীনতার বাণী শোনায় সেখানে সাম্প্রদায়িকতার সূত্রপাত সেই মানুষের দ্বারাই হয়। বিষয়গুলো কি খুবই অদ্ভুত না! যখন মানুষ মানুষের অধিকার হরণে বরাবরই পরিশ্রমী সেখানে মানবাধিকার নিশ্চায়নের দাবি করাটা নির্রজ্জতার পরিচয় বলা যায়। এখন যদি প্রশ্ন ছোড়া হয় যে মুষ্টিমেয় নেতিবাচক চিন্তাসম্পন্ন ও অমানবিক লোকদের জন্য পুরো মানব সম্প্রদায়কে দোষারোপ করা তো কোন নীতিশাস্ত্রের কথা হতে পারে না, তবে তার উত্তরে বলা উচিত সমাজে ঐরূপ মুষ্টিমেয়দের অস্তিত্ব জেনেও যারা পুরোপুরিভাবে নীরব তাদেরকে উৎসর্গ করেই এইসব বলা।
মানুষ মানুষের জন্য কি করতে পারছে! আমাদের সমাজে কত নারীরাই চলাফেরার পথে নানা হেনস্তার স্বীকার হচ্ছে, এর ব্যাখ্যা কি! কেনো পুরুষরা কি পারে না তাদের লালসার চক্ষুকে লাগাম দিয়ে নারীদের স্বাধীনভাবে চলার অধিকার, নিরাপত্তা লাভের অধিকার নিশ্চিত করতে!
মানুষের জন্ম মানুষের অধিকার হরণের উদ্দেশ্যে, হক নষ্ট করার উদ্দেশ্যে নয় বরং মানুষের সৃষ্টি মানুষের কল্যাণে আর এই কল্যাণই যদি অকল্যাণের কারণ হয়ে দাঁড়ায় তবে মানবসমাজের গতি কোন দিকে! গরীবের হক নষ্ট করে পরিচিতি পাবার লোভে লোকসম্মুখে সেই গরীবের সাহায্যে এগিয়ে যাওয়াটা গরু মেরে জুতো দানের সমতুল্য নয় কি!
তাই অনুসন্ধানের চক্ষুটিকে আরো সূক্ষ্ম করে কাজে লাগাতে হবে। মানবাধিকার আদায়ের দাবিতে চেচিয়ে উঠা সহজ কিন্তু মানবাধিকার রক্ষার উদ্দেশ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে যাওয়াটাই মূখ্য। মানুষের অধিকার আদায়ে শুধু রাষ্ট্রকে সচেষ্ট হওয়ার বাণী না শুনিয়ে মানুষের নিজেদের মানসিকতায় ইতিবাচকতা আনতে হবে ও মানবতার হৃদয়কে প্রসারিত করতে হবে। একটি জাতির কল্যাণে শুধু একপাক্ষিক প্রচেষ্টাই যথেষ্ট ও সর্বদা যুগোপযুগী নয় বরং সম্মিলিত প্রচেষ্টাই কাম্য। খাতা-কলম নিয়ে কোন রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থার সমালোচনার দ্বারা পরিচিতি প্রাপ্তির চেয়ে কোন মহৎ কাজের দ্বারা সকলের মুখের বুলি হওয়াটাই স্পৃহণীয়। মানবাধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রব্যবস্থার পাশাপাশি মানুষের মাঝেও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। বিবেকের দ্বারা তাড়িত হওয়ার নেয়ামত স্রস্টা একমাত্র মানবজাতিকেই দিয়েছেন। তাই সেই বিবেক কাজে লাগিয়ে মানুষের কল্যাণে অগ্রগামী হতে হবে। অকল্যাণের অভিশাপকে পদতলে পিষে দিয়ে নিজের চিন্তাশক্তিতে ইতিবাচকতা আনয়নের দ্বারা নিজেকে মানুষের জন্য কল্যাণের পাত্রে পরিণত করতে হবে। মানুষ তাদের অধিকার নিয়ে শান্তিতে তা ভোগ করতে চায়। কারো অধীনে থেকে চলাফেরা করা,কারো ভোগের পাত্র হয়ে বেঁচে থাকা কোন মানুষের আকাঙ্ক্ষার বিষয় হতেই পারে না।
লেখনীর দ্বারা হয়তো মানুষের বিবেকে নাড়া জাগানো যেতে পারে কিন্তু মানুষের বিবেক নিয়ন্ত্রণ করা জগতের কোন লেখক বা কারো দ্বারাই সম্ভব নয়। তাই নিজ বিবেক কাজে লাগিয়ে চিন্তাশক্তিকে ইতিবাচক দিকে ধাবিতকরণ ও মানবতার চক্ষুকে প্রসারিত করণের দ্বারা মানবাধিকার আদায় ও এর সুরক্ষায় মানুষকেই পরিশ্রম করতে হবে। “মানুষ মানুষের জন্য”– প্রকৃতপক্ষে এর বাস্তবায়নের দ্বারাই মানবাধিকার নিশ্চিতের আশা করা যায়।
Leave a Reply