শাহিনুর রহমান সোনা, রাজশাহী: সীমান্ত এলাকা এবং নদীপথ হওয়ায়
রাজশাহী জেলার মাদকের সবচেয়ে বড় স্পট গোদাগাড়ী আর চারঘাট উপজেলা। কোটি কোটি টাকার মাদকের কারবার হয় সেখানে। কারবার ঠেকাতে এখানে প্রশাসন অর্থাৎ র্যাব, পুলিশ ও বিজিবি'র রয়েছে কঠোর নজরদারি।
কিন্তু বাতির নীচেই অন্ধকার অর্থাৎ সেখানে মাদক কারবারিদের কাছ থেকে র্যাব, পুলিশ ও বিজিবি'র কিছু অসাধু কর্মকর্তার নাম করে টাকা তোলে মিন্টু। এই মিন্টু সম্পর্কে জানলেই মাদক কারবারি চক্রের নানান অজানা তথ্য জানা যাবে বলে জানিয়েছে খোদ মিন্টুই। এরকম আরও মিন্টু রয়েছে এখানে।
এই প্রতিবেদকের হাতে মিন্টুর সাথে কপোপকথনের প্রায় দুই ডজন অডিও ক্লিপ থেকে বেরিয়ে এসেছে এসব তথ্য। বেরিয়ে এসেছে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় মিন্টুর ভিন্ন ভিন্ন একাধিক নাম। সে বিজিবি'র কাছে সবুজ, র্যাব ও ডিবি পুলিশের কাছে মাইকেল এবং পুলিশের কাছে আসল নাম মিন্টু নামে-ই পরিচিত।
তার পুরো নাম মিন্টু মিয়া (২৫)। সে নাটোর জেলার সদর উপজেলার ছাতনী গ্রামের নজরুল ইসলামের ছেলে। মূলত মিন্টু মিয়া একজন মাছ ব্যবসায়ী। আড়ালে মাসোহারা তোলার কাজ। মাছ বিক্রেতা থেকে তার কোটিপতি হয়ে ওঠার গল্পটাও এখানে।
সূত্র বলছে, প্রতারক মিন্টু প্রশাসনের নামে মাদক কারবারি ও সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে কোটি টাকা চাঁদা আদায় করে। সে প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে বিভিন্ন নামে পরিচিত বলেও ফাঁস হওয়া কল রেকর্ড থেকে বেরিয়ে আসে। প্রতারক মিন্টু প্রতিমাসে র্যাব, পুলিশ, বিজিবি, পিবিআইসহ প্রশাসনের বিভিন্ন অসাধু কর্মকর্তা'র নামে মাদক স্পট থেকে মাসোহারা তোলে।
অডিও কল থেকে জানা যায়, সে প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা যেমন র্যাব, পুলিশ, বিজিবি, জেলা ডিবি পুলিশ ও পিবিআই এর কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে মাসোহারা ও মামলার ভয় ভীতি দেখিয়ে মোটা অংকের টাকা দাবি করছেন। গোদাগাড়ী ও চারঘাট এলাকার মাদক কারবারিরা তাকে প্রশাসনের মাসোহারা আদায়কারী হিসেবে চেনে।
সম্প্রতি সোর্স মিন্টু গোদাগাড়ীতে কয়েকজন মাদক কারবারি ও সাধারণ মানুষকে ভয় দেখিয়ে টাকা দাবি করে। কিন্তু মাদক কারবারিরা তাকে টাকা দিলেও সাধারণ মানুষরা তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে শুরু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় টাকা দাবি করা কয়েকজনের অডিও কল রেকর্ড ফাঁস করেন। সর্বশেষ গোদাগাড়ীর একজন সাধারণ মানুষকে মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দিয়ে এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে সে।
অডিও কল রেকর্ডে শোনা যাচ্ছে, পিবিআই রাজশাহীতে কর্মরত একজন পুলিশ অফিসারের নাম বলে সে টাকা দাবি করছে। অডিও কলে ওই পুলিশ কর্মকর্তা নাম সুমন বললেও আসলে তার পাঠানো ছবি অনুযায়ী সে এএসআই রবিউল। মিন্টুর সাথে এএসআই রবিউলের টাকা লেনদেনের একটি অডিও কল রেকর্ডও ফাঁস হয়। মুলত চাঁদা দাবিকারীর কাছে বিশ্বাস যোগাতেই মিন্টু ওই কর্মকর্তার অডিও কল রেকর্ড তাকে দেয়। জানা যায়, পিবিআই রাজশাহীতে কর্মরত এএসআই রবিউলের বাড়ি ও প্রতারক মিন্টু দুজনের বাড়িই নাটোর জেলায়।
পিবিআই এর এএসআই রবিউল এসব অস্বীকার করে বলেন, এরকম কাউকে চিনি। অডিও কলে তাঁর ভয়েস কিনা জানতে তাকে অডিও কলের কথপোকথন শোনালে তিনি বলেন এটা আমার ভয়েস না।
অপর একটি অডিও কল রেকর্ডে শোনা যাচ্ছে, মিন্টু জেলা পুলিশের সনাতন চক্রবর্তীর নামেও তাকে ভয় দেখাচ্ছে। এমনকি ওই অফিসারের সঙ্গে তার কথা হয়েছে, টাকা দিলে মামলা থেকে নাম কাটিয়ে দেবে সে। এরকম বহু মামলায় অজ্ঞাত নামে তিনি অনেকের নাম কাটিয়েছেন আবার অনেকের নাম ঢুকিয়েছেন। কল রেকর্ডে সনাতন চক্রবর্তীকে এসপির পরে তার অবস্থান বলে উল্লেখ করতে শোনা যাচ্ছে। এই অডিওতে কথা বলার সময় পুলিশের গাড়ীর হুইসেলও শোনা যাচ্ছে।
গোদাগাড়ীর একাধিক সূত্র বলছে, মিন্টু মুলত জেলা ডিবি'র পরিদর্শক আতিকুর রেজা'র লোক। তার নামে মাসোহারা তোলা তার কাজ৷ যারা মাসোহারা দেয় না তাদেরকে আতিকুরকে দিয়ে আটক করানো হয় এবং মামলা দেয়া হয়। অডিওতে মিন্টুকে বলতে শোনা যাচ্ছে , উজ্জ্বল নামে একজনকে কথা না শোনায় আটক করিয়েছি । র্যাবের মাঠ পর্যায়ে দুজন অফিসারের নামও বলতে শোনা যায় তাকে। তাদের সঙ্গে তার সক্ষতা রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন। অডিওতে নাম নেওয়া ওই কর্মকর্তাদের নাম ইমদাদ ও মাসুদ বলে শোনা যায়।
কয়েকজন সাধারণ ভুক্তভোগী বলেন, মিন্টুর অনেক ক্ষমতা যখন তখন যে কাউকে ফাঁসাতে পারেন। যাকে তাকে আটক করানোর ক্ষমতা রয়েছে। তার কথায় প্রশাসন মামলা দেয়। ইতোমধ্যে সে যখন যা বলেছে তাই হয়েছে বা করেছে। একারণে তাকে সবাই ভয় পায়।
একের পর এক হয়রানি শিকার এক ভুক্তভোগী পরিবার জানান, ওই সোর্স গোদাগাড়ী বিভিন্ন মাদক ব্যবসায়ীর নিকট বিজিবি, র্যাব, ডিবি পুলিশের লোক বলেই পরিচিত। মাসোহারা না পেলে সে তৎক্ষনাৎ তাদের আটক করায়। এর আগে এক মাদক কারবারি হুমকি দিয়ে চাঁদা না পেয়ে ডিবি'র পরিদর্শক আতিকুর রেজাকে দিয়ে ধরিয়ে দেন। অপরদিকে গত ১৫ নভেম্বর মাদক না পেয়েও একজনকে টাকা নেওয়ার উদ্দেশ্যে আটক করায় এবং টাকা না পেয়ে পরে মামলা দেয়।
এদিকে ওই সোর্স মিন্টুর মোবাইল নম্বর দিয়ে ট্রুকলারে সার্চ দিলে সিও মিন্টু নাম ভেসে আসে।
প্রতারক মিন্টুর মোবাইল নম্বরে ফোন দিলে তিনি বলেন, আমার বিরুদ্ধে যে সকল অডিও দেওয়া হয়েছে তা সম্পুর্ণ সত্য নয়। আমার কাছেও অনেক অডিও ভিডিও ফুটেজ আছে। সেগুলো শুনলে বুঝতে পারবেন আসল ঘটনা কি ? আমি আপনাদের সঙ্গে দেখা করবো তখন সব বলবো।
কথা বলতে জেলা ডিবি'র পরিদর্শক আতিকুর রেজাকে মুঠফোনে না পাওয়ায় তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
রাজশাহী জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সনাতন চক্রবর্তী বলেন, বিষয়টি আমার জানা নাই। তবে খোঁজ খবর নিচ্ছি। বিষয়টি দেখছি বলে ফোন কেটে দেন।
পিবিআই রাজশাহীর সদ্য যোগদানকৃত অতিরিক্ত উপ মহা পুলিশ পরিদর্শক মনিরুল ইসলাম বলেন, অডিও ক্লিপস গুলো সহ অন্যান্য তথ্য গুলো আমাকে দিন, আমি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করবো।