প্রিন্ট এর তারিখঃ নভেম্বর ২৩, ২০২৪, ৮:২০ এ.এম || প্রকাশের তারিখঃ সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২৪, ২:৫০ অপরাহ্ণ
রাজশাহী কলেজ অধ্যক্ষ সমাচার: হবিবুর থেকে আনারুল হক
রাজশাহীর বিভিন্ন শিক্ষা অফিস, পত্রিকা অফিস, গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে পাঠানো একটি লিফলেট শিক্ষা মহানগরীতে বেশ আলোচিত সমালোচিত হচ্ছে। রাজশাহী কলেজের বর্তমান শিক্ষার্থী ও বৈষম্যের শিকার শিক্ষকগণের পাঠানো এই লিফলেট অনেকেই ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডিতে প্রচার করেছেন। পাঠকের জন্য হুবহু এই লিফলেট বা প্রচার পত্রটি তুলে ধরা হলো।
একটি প্রবাদপ্রতিম কথা আছে- ‘যার যোগ্যতা কম, তার আড়ম্বর বেশি।’ রাজশাহী কলেজের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী কলেজের দুই অযোগ্য সাবেক অধ্যক্ষের ক্ষেত্রে এই প্রবাদটি সর্বাংশে সত্য। এই দুই সাবেক অধ্যক্ষ হচ্ছেন আড়ম্বর প্রিয় অধ্যাপক হবিবুর রহমান এবং ছাত্রদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত ও বিতাড়িত অধ্যাপক আনারুল হক প্রাং। তাঁরা দুজনেই নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির মাহোৎসবে মেতে ছিলেন প্রায় ১৫ বছর ধরে।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময়কালে এই দুই অধ্যাপক রাজশাহীতে ছিলেন ব্যাপক সমালোচনা এবং নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। হবিবুর রহমান দিনাজপুর ফুলবাড়ি বেসরকারী কলেজের প্রভাষক থাকাকালে রাষ্ট্রপতি এরশাদের সময় জাতীয়করণ হওয়ার সুবাদে লটারীর মতো সরকারী কলেজের চাকরি পেয়ে যান। বিসিএস দিয়ে সরকারী কলেজের চাকরি পাওয়ার যোগ্যতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হয়েও বনে যান বিসিএস ক্যাডার। দীর্ঘদিন রাজশাহী নিউ গভ: ডিগ্রি কলেজে রসায়ন বিষয়ের একজন প্রাইভেট পড়ানো টিচার হিসেবে তার পরিচিতি গড়ে ওঠে। দিনরাত বাড়িতে পালাক্রমে শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়াতেন তিনি। সেটাও শুধুমাত্র উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির শিক্ষার্থীদের। ফলে তাঁর অনার্স-মাস্টার্স পড়ানোর কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না। এইভাবে প্রায় একদশক পরে নিউ গভ: ডিগ্রি কলেজে ১০% কোটায় পদোন্নতি পেয়ে ২০১০ সালে অধ্যাপক হন। কিন্তু তাঁর কোন প্রকাশনা বা লেখালেখি নেই। পদোন্নতি পেয়ে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে রসায়ন বিভাগে তার পদায়ন হয়। সেখান থেকে তদবির করে তিনি রাজশাহীর সাবেক সিটি মেয়র এ.এইচ.এম খায়রুজ্জামানের আশির্বাদপুষ্ট হয়ে রাজশাহী কলেজের উপাধ্যক্ষ পদ লাভ করেন। সেই সময় রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব প্রফেসর ড. আলী রেজা মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ। অধ্যক্ষ ছিলেন ধর্মপ্রাণ একজন খাঁটি ভদ্রলোক। তাঁর ভদ্রতা ও সরলতার সুযোগ নিয়ে উপাধ্যক্ষ হবিবুর রহমান সরাসরি জড়িয়ে পড়েন নানা আর্থিক অনিয়ম ও দূর্নীতির সঙ্গে। তিনি বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার রাজশাহী অঞ্চলের সভাপতির পদও বাগিয়ে নেন। এতে ক্যাডার অফিসারদের মধ্যে অসন্তোষ ও বিরোধ সৃষ্টি হয়। সেই সময় রাজশাহীর চারটি জেলা যেমন-নাটোর, নবাবগঞ্জ, বগুড়া ও নওগাঁর সমস্ত বেসরকারী কলেজের শিক্ষক/অধ্যক্ষ/উপাধ্যক্ষ নিয়োগের জন্য মহাপরিচালকের প্রতিনিধি হিসেবে রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। অধ্যক্ষকে উপেক্ষা করে হবিবুর রহমান এককভাবে তার সহযোগী কয়েকজন শিক্ষককে সঙ্গে নিয়ে সেই সময়ের বেসরকারী কলেজ শিক্ষক সমিতির সভাপতি কোর্ট কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ শফিকুর রহমান বাদশাহ ও সম্পাদক পুলিশ লাইন কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ গোলাম মাওলার সঙ্গে গড়ে তোলেন নিয়োগ ও তদবির বাণিজ্য সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে হাবিবুর রহমান গং হাতিয়ে নেন শত শত কোটি টাকা। ড. আলী রেজা আব্দুল মজিদ পবিত্র হজব্রত পালনের উদ্দেশ্যে সৌদি আরব গেলে হবিবুর রহমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পান। দায়িত্ব পেয়েই কলেজের অধ্যক্ষের কক্ষে রক্ষিত সিন্দুকে আপদকালীন ফান্ডের প্রায় ৩২ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেন হাবিবুর রহমান। হজ্বব্রত শেষ করে অধ্যক্ষ ড. আলী রেজা মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ ফিরে এসে অর্থের হদিস না পেয়ে সমুদয় অর্থ আত্মসাতের জন্য হবিবুর রহমানের প্রতি চরম ক্ষুদ্ধ হন এবং অনেকের নিকট এই বিষয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেও তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক কোন ব্যবস্থা নিতে পারেন নি। কারন ছাত্রলীগ ও অসাধুচক্রকে মাসোহারা দিতেন হবিবুর রহমান। এমতাবস্থায় তিনি অবসরে গেলে হাবিবুর রহমান পূর্ণ অধ্যক্ষরূপে নিয়োগ পান। প্রায় দশ বছর তিনি অধ্যক্ষ পদে বহাল থেকে নিয়োগ বাণিজ্য, থেকে শুরু করে কলেজের বিভিন্ন ফান্ড যেমন- ৩০টি বিভাগের সেমিনার ফান্ড, উন্নয়ন ফান্ড, আপ্যায়ন ফান্ড, লাইব্রেরি ফান্ড, আপদকালীন ভান্ডার এবং পাবলিক পরীক্ষা পরিচালনা ও ছাত্র উন্নয়ন তথা ছাত্রসংসদের ফান্ডের লক্ষ লক্ষ টাকা তসরুফ করেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন কলেজে নতুন নতুন ভবন হলেও হবিবুর রহমান কোন নতুন ভবন তৈরিতে উদ্যোগী না হয়ে টেন্ডার ছাড়াই বিভিন্ন বিল্ডিংয়ের রং করা, অভ্যন্তরীন রাস্তা ও পুরাতন ভবনের প্লাস্টারসহ নানা স্থাপনার সংস্কারের নামে প্রতিবছরেই হাতিয়ে নেন লক্ষ লক্ষ টাকা। তিনি অতি দরিদ্র পরিবারের সন্তান হলেও নতুন নতুন প্রিমিও কার ঘন ঘন পরিবর্তন, সাজ-সজ্জার বাহার ও চালচলনে তার আয়ব্যয় ও জীবন নির্বাহের কোন সঙ্গতিই ছিল না। যা ছিল অশোভন ও দৃষ্টিকটু। শিক্ষকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করাই ছিল অভ্যাস। এমতাবস্থায় দশ বছর অতিবাহিত করে তিনি নিজের উদ্যোগে সাতদিনব্যাপী কলেজের খরচে নির্লজ্জভাবে নিজের বিদায় অনুষ্ঠান উদযাপন করে সবাইকে তাক লগিয়ে দেন। নিজের প্রশংসায় প্রশংসিত হতে আমন্ত্রণ জানান সাবেক সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামানসহ অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তিকে। এছাড়াও একজন সরকারি চাকরিজীবী হয়েও চাকরির নিয়ম শৃঙ্খলার তোয়াক্কা না করে নবাবগঞ্জ জেলা সমিতির সভাপতি হিসেবে নিজেকে জাহির করে বেড়ান। সাবেক সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন, জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের জন্য প্রকাশ্যে ভোট প্রার্থনা ও প্রচারণায় জড়িয়ে পড়েন। সাবেক মেয়রের একজন বিশ্বস্ত স্তাবক হিসেবে তিনি লাভ করেন “কামরারুজ্জামান নার্সিং ইন্সিটিউটের মহাপরিচালক পদ। আদৌ নার্সিং ইন্টিটিউটে এই রকম পদ কোথাও নেই। নিজের নাম আড়ম্বরপূর্ণ করা ও পদ জাহির করার জন্য তিনি এই পদমর্যাদা তুলে ধরে মূলত রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষের পদটি কলুষিত করেছেন। এইখানেও তিনি আর্থিক অনিয়মে যুক্ত ছিলেন। নার্সিং প্রশিক্ষকদের সম্মানীও আত্মসাৎ করতেন নিয়মিত। এই বিষয়েও সিটি কর্পোরেশন তার বিরুদ্ধে একটি মহল খুব ক্ষুদ্ধ ছিলেন। তবে সাবেক মেয়রের ঘনিষ্ঠ বিধায় তাকে কেউ কিছু বলার সাহস পেতো না। সিটি কর্পোরেশনের আরেকটি কোটি টাকার প্রকল্প ‘স্কিল ডেভলপমেন্টের অন্তর্গত কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কোর্সের উপদেষ্টা হিসেবে হবিবুর রহমানকে নিয়োগ দেন সাবেক মেয়র লিটন। এই প্রকল্পেও তিনি দুর্নীতির মহোৎসব শুরু করেন। অফিস সামগ্রী ক্রয়ে বিশাল দুর্নীতি করেন, প্রশিক্ষকদেরকে সাদা কাগজে সিগনেচারে বাধ্য করে শিক্ষকদের মাসিক সম্মানি ভাতা থেকে বিশাল অঙ্কের টাকা আত্মসাৎ করেন।
ওদিকে রাজশাহী কলেজের আর্থিক অনিয়মের জন্য এখনো ৭টি অডিট আপত্তি তার বিরুদ্ধে রয়ে গেছ্ েঅডিট নিষ্পত্তির জন্য সাবেক অধ্যক্ষ খালেককে তিনি বার-বার চাপ সৃষ্টি ও গালিগালাজ করেন। অধ্যক্ষ আব্দুল খালেক তাঁর আর্থিক অনিয়মের দায়ভার গ্রহণ করেন নি। তদুপরি সাবেক মেয়র লিটন আবারও তাকে রাজশাহী ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের সম্পাদক নিযুক্ত করায় সেখানেও তিনি বিভিন্ন দাতার দেয়া অর্থ আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ আছে। হার্ট ফাউন্ডেশনের যন্ত্রপাতি ক্রয়ে তিনি ব্যাপক অর্থ আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বর্তমানে আওয়ামী বিরোধী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গেও তিনি মিশে গেছেন। তাঁর অতীত কালিমা যেন মুছে যায় এই প্রত্যাশায়। এই বিষয়ে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, হবিবুর রহমান গিরগিটির মতো রঙ বদলকারী একটি চরিত্র। তাঁর কোন নীতি আদর্শ নেই।
অপরদিকে সদ্য যোগদানকৃত এবং শিক্ষার্থীদের দ্বারা প্রত্যাখিত এবং বিতাড়িত সাবেক অধ্যক্ষ আনারুল হক প্রাং একই পথের পথিক। তিনিও বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কখনো ক্লাসে এসে পাঠদানের প্রতি মনোযোগী না হয়ে সবসময় লোভনীয় চেয়ার দখলে ছিলেন ব্যস্ত। অত্যন্ত উচ্চাভিলাসী, পদলোভি এই ব্যক্তি রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও সচিব এর মতো তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করেছেন প্রায় এক যুগ। বিস্তর অভিযোগ ও সত্যতা মিলেছে তাঁর বিরুদ্ধেও। দুদক কর্তৃক অভিযুক্ত ও মামলায় প্রমানিত হয়ে দণ্ড দিয়ে মুক্তি লাভ করেছেন তিনি। শহীদ বুদ্ধিজীবী কলেজে নিয়োগ পান সাবেক এম.পি. আয়েন উদ্দীনের আত্মীয়তার সুবাদে তার চাকরি রক্ষা হয় সেই সময়ে। স্থানীয় অনুগ্রহে তিনি রক্ষা পেয়েছিলেন অথচ সমস্ত অতীত কীর্তি কলাপ মুছে দিয়ে আবার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষের পদে এসে এই পদলিপ্সু, লোভী এবং অসৎ শিক্ষক আনারুল হক প্রাং প্রত্যাখ্যাত হলেন শিক্ষার্থীদের দ্বারা। রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষের মতো মর্যাদাপূর্ণ চেয়ার ও পবিত্র কলেজ অঙ্গন কলঙ্কিত করেছেন এইসব অসৎ মিথ্যাচারী, অযোগ্য অধ্যক্ষেরা। এমতাবস্থায় সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের প্রাণের দাবী এই প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে যে সৎ, দক্ষ ও যোগ্য অধ্যক্ষ নিয়োগ দেয়া হয়েছে তিনি সকল সমালোচনার ঊর্ধ্বে থেকে এই শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিকে আবারো শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠে পরিণত করবেন।
© 2024 Probashtime