নারায়ণগঞ্জে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তানিয়া তাব্বাসুম তমা। হোম আইসোলেশনে থাকা এ ম্যাজিস্ট্রেট করোনাকালে নারায়ণগঞ্জে কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে ফেসবুকে আবেগঘন স্ট্যাটাস দিয়েছেন। সেই স্ট্যাটাস বিবার্তা২৪ ডট নেট’র পাঠকদের কাছে হুবহু তুলে ধরা হলো।
‘কোভিড-১৯ যুদ্ধ ও জনসেবায় প্রশাসন’ শিরোনামে সোমবার রাত ১২টা ৩৫ মিনিটে পোস্ট করা স্ট্যাটাসে ম্যাজিস্ট্রেট তানিয়া তাব্বাসুম তমা লিখেছেন- করোনার ভয়াল থাবা এসে পড়তে দেরি নেই, সবাই প্রস্তুত হও~ সরকারের নির্দেশ।
সরকারের কর্মচারী তাই পিছপা হবার সুযোগ নেই। দেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধই প্রশাসনে চাকরির ধর্ম। অগত্যা ১ বছরের তাইফ আর ৩ বছরের নামিরাকে মায়ের কাছে ঢাকায় রেখে নারায়ণগঞ্জে থাকতে শুরু করলাম। নিয়মিত অফিস, মোবাইল কোর্ট, গণসচেতনতা কার্যক্রম, জরুরি ত্রাণ কাজ, কন্ট্রোল রুম ডিউটি, প্রতিদিনের রিপোর্টসহ প্রেস ব্রিফিং তেরি, বেসরকারি ত্রাণ সংগ্রহ কার্যক্রম যখন যেটা সামনে পড়েছে, করেছি। ভাবছেন এতো বলছি কেন, এসব তো প্রশাসনের কাজই। হ্যাঁ, সেজন্যই ফটোসেশন, ফেসবুক পোস্ট বাহুল্য এড়িয়ে চলেছি। আমি খুব নিভৃতচারী, তাই কাজকে প্রাধান্য দিয়েছি আগে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের ছাত্রী ছিলাম, তাই জীবাণু নিয়ে কিছুটা অভিজ্ঞতা রাখি বলে দাবি করি।জীবানু ভীতিটাও তাই সরিয়ে রেখে কাজ করতে পেরেছি, বোধ হয়। সারাদিনের চেষ্টা, ক্লান্তি শেষে যখন দেখতাম লোকজন কথা শুনছে না, একই ব্যক্তি নানা অজুহাতে ঘরের বাইরে আসছে, ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়ে ত্রাণ চাইছে, আর প্রশাসনের সব কাজ নিয়েই, যত দোষ নন্দঘোষ অপপ্রচার। তখন শুধু নতুন উদ্যম হাতরে খুঁজে বেড়াতাম। কিন্তু খারাপ লাগা ঘিরে ধরতো যখন ভিডিও কলে সন্তানের মুখ আর প্রিয় স্বরগুলো শুনতে পেতাম। নিজের চেয়ে বেশি ভাবতাম পরিবারকে নিয়ে। জানেন, কতো রাতে ঘুমাতে পারিনি। শারীরিক-মানসিকভাবে কিছুটা দুর্বলও হয়ে পড়েছিলাম। তার মধ্যে সারা দেশে রি-রি করে উঠলো প্রশাসন, বিশেষ করে নারায়ণগন্জ্ঞ জেলা প্রশাসন নাকি PPE চোর। অথচ ডিসি স্যার নিজ উদ্যোগে আমাদের সেটা যোগাড় করে দিয়েছিলেন। পরে যতো বেসরকারি PPE পাওয়া গিয়েছিলে চিকিৎসকসহ অন্য সবাইকে দেওয়া হয়েছিলে জনস্বার্থে। যাইহোক ন্যূনতম নিরাপত্তাটুকু নিয়েই কাজ চালিয়ে গিয়েছি, সব প্রশাসন যোদ্ধারাও সারাদেশে তাই করছে।
মুসলমান হিসেবে মৃত্যু ভয় মনে রাখিনি, প্রিয় নারায়ণগঞ্জবাসীর প্রাণ বাঁচাতেই দৌড়ে বেড়িয়েছি। নিজ জেলা চাঁদপুর, কিন্তু কর্মস্থল দেশের সমৃদ্ধ একটি জেলা নারায়ণগঞ্জকে আজকে যখন লোকে বাংলাদেশের উহান বলছে, তখন বুকটা মুচড়ে উঠে। আপনাদের সেবা করতে গিয়ে আজ জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা কর্মচারী আক্রান্ত, ত্রাণ কাজের একজন পরিশ্রমী কর্মচারী মৃত্যুবরণ করেছেন। এখনও মনে পড়ছে, শেষ যেদিন সন্ধ্যায় কাশিপুর, গোগনগর এলাকায় মোবাইল কোর্ট করছিলাম মাইকে চিৎকার করে বলছিলাম ‘প্রিয় নারায়নগঞ্জবাসী, এ জেলার অবস্থা আর কতো খারাপ হলে আপনারা সচেতন হবেন!’
আজ আমি, আমার পরিবার (স্বামী-মা), প্রশাসন পরিবার কোভিড-১৯ আক্রান্ত। আমাদের করোনা রিপোর্ট পজিটিভ পাওয়ার পর আত্মীয়, বন্ধু বিশেষ করে বাংলাদেশ এডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন আমাকে যেভাবে সাহস যুগিয়ে যাচ্ছেন মনে হচ্ছে এ যাত্রায় বেঁচে গেলে আল্লাহ যেন দ্রুত আবার সুস্হ করে দেন, দেশের সেবা করার তৌফিক দেন। তাদের সবার নাম বলতে গেলে তালিকাটি দীর্ঘ হয়ে পোস্টটি আরেও বড় হয়ে যাবে। অসংখ্য ধন্যবাদ সবাইকে।
ভালো থাকুক নারায়ণগঞ্জ, ভালো থাকুক প্রিয় দেশ। সবাই আমার ও আমার পরিবারের জন্য দোয়া করবেন। সাধারণ এ জীবনে বহু ঘাত প্রতিঘাত পার করেছি। সন্তান দুটো জন্ম দিতে গিয়ে দু-দুবার মৃত্যুর মুখ থেকে আল্লাহ ফিরিয়ে দিয়েছেন ওদের ভাগ্যে। আবার যেন আমরা প্রিয় মুখগুলোর কাছে ফিরে যেতে পারি, আল্লাহ যেন সবাইকে তার রহমতের ছায়ায় রাখেন। আমিন।
Leave a Reply