করোনাভাইরাসের কারণে স্থবির হয়ে পড়েছে বিশ্ব। সৃষ্টি হচ্ছে নানা ধরনের নতুন প্রতিবন্ধকতা। জনমনে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক। ঘরবন্দী হয়ে পড়েছে মানুষ। লোকসান পোহাতে হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। কর্মহীন হয়ে গেছে বৃহৎ জনগোষ্ঠী। করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে লকডাউন করা হয়েছে বিভিন্ন এলাকা। এতে অসহায় হয়ে পড়েছে নিন্ম আয়ের লোকজন। দেখা দিয়েছে খাদ্যাভাব। সংসার পরিচালনায় হিমশিম খাচ্ছে কর্মহীন পরিবারের অভিভাবকরা। পরিশ্রিতি মোকাবেলায় লকডাউন উপেক্ষা করে কর্মের খোঁজে ঘর থেকে বের হচ্ছে তাঁরা। এতে করে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ পরিশ্রিতিতে বিপাকে পড়েছে কর্মহীন শ্রমজীবী মানুষ।
করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে কঠোর হচ্ছে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এমন অবস্থায় শ্রমজীবীরা প্রশাসনের সাথে চোর পুলিশ খেলে খাবারের সন্ধানে ঘর থেকে বের হচ্ছে। লকডাউন উপেক্ষা করে ঘর থেকে বের হওয়ার কারণে লাঞ্চিত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। সরকার থেকে বার বার ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে নিজের ঘরে থকার জন্য। কিন্তু ঘরে যদি খাবার না থাকে তবে মানুষ কিভাবে থাকবে? করোনাভাইরাসে সংক্রমণ হওয়ার আগে তাঁরা মারা যাবে ক্ষুধায়। কারণ এসব নিন্ম আয়ের শ্রমজীবী মানুষ দৈনিক যা আয় করে তা দিয়েই টেনেটুনে চলে তাদের সংসার। সঞ্চয় করে বসে খাওয়ার মতো অবস্থা তাঁদের নেই। তাই করোনাভাইরাসের এই ভয়াল থাবায় গভীর সংকটে পড়েছে দেশের শ্রমজীবী মানুষ। দেশের আনুষ্ঠানিক খাতের সোয়া ৫ কোটি শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়েছে। এসব মানুষ এখান বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করছে প্রতিদিন।
শ্রমজীবীদের মলিন মুখ জুড়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কা। স্থাস্থ্যঝুঁকির কারণে ঘর থেকে বের হয়ে কাজে যেতে পারছে না তাঁরা। সব কিছু বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেকার হয়ে পড়েছেন দিন আনে দিন খায় এমন লাখ লাখ মানুষ। রিকশাচালক, গাড়িচালক, কৃষিশ্রমিক, দিনমজুর, দোকনদার , ফুটপাতের ছোট ব্যবসায়ীসহ এমন খেটে খাওয়া বিভিন্ন পেশার লোকজন এখন ঘরবন্দী। সীমিত পরিসরে পোশাক কারখানা খুললেও সেখানকার শ্রমিকরাও আছেন স্বাস্থ্য ও চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৭ অনুযায়ী, দিন আনে দিন খায় এমন ৮৫ শতাংশ দেশের কর্মজীবী মানুষ অনুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। ৬ কোটি ৮ লাখ লোক মজুরির বিনিময়ে কোন না কোন কাজ করছেন। কাজের নিশ্চয়তা নেই এমন ৫ কোটির বেশি মানুষ দেশের অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। তাঁরা অনেকটা দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে কাজ করেন। বাকিরা অনুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন।
দেশের অনানুষ্ঠানিক খাতে শ্রমজীবী লোকের মধ্যে কৃষি খাতে আছেন ২ কোটি ৩০ লাখ ৪৮ হাজার নারী-পুরুষ। শিল্প খাতে ১ কোটি ১১ লাখ ৬৮ হাজার মানুষ কাজ করেন। আর সেবা খাতে আছেন প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ।
এই করোনাকালে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে উৎপাদন খাত। লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। বিবিএসের উৎপাদন শিল্প জরিপ ২০১৯ এর প্রাথমিক ফলাফল অনুযায়ী, দেশে ছোট, বড়, মাঝারি ও অতি ক্ষুদ্র মিলিয়ে ৪৬ হাজার ২৯১টি কারখানা আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছোট করাখানার সংখ্যা ২৩ হাজার ৫৭৭। দেশেজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এসব ছোট কারখানায় কাজ করেন ১১ লাখ ২৭ হাজার ৮৪১ জন শ্রমিক।
করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সরকারি স্বাস্থ্যবিধি এবং সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিতে এসব শ্রমজীবী মানুষ ঘর থেকে বের হতে পারছে না। সঞ্চয় না থাকায় তাদের ঘরে দেখা দিয়েছে খাদ্য সংকট। অভাব-অনটনে অসহায় হয়ে অনাহারে দিন কাটাছে তাঁদেরর। ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে আত্নহত্যার ঘটনাও ঘটেছে। করোনার কারণে অসহায় হয়ে পড়া ব্যক্তিদের খাদ্যসামগ্রী দিচ্ছে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন। যা চাহিদার তুলনায় যথসামান্য। আবার সে খাবার পেতেও ভোগান্তির শেষ নেই। খাবার নিতে গিয়ে হুড়োহুড়ি করে পদদালিত হয়ে আহতও হয়েছে অনেকে। সরকারি ভাবে তেমন সহযোগিতা না পাওয়ায় শ্রমজীবীদের মাঝে বাড়ছে দুশ্চিন্তা। করোনা সংক্রমণ মোকাবেলা থেকে এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়েছে অসহায় কর্মহীন মানুষের খাদ্য নিশ্চিত করা। অন্যদিকে দেশের এই ক্লান্তিকালেও চাল চুরির হিড়িক পড়েছে। এছাড়াও পাকা বোর ধান নিয়ে বিপাকে পড়েছে কৃষকরা। উচ্চ মজুরি দিয়েও শ্রমিক পাচ্ছেন না। চিন্তার ভাঁজ পড়েছে কৃষকদের কাপালে।
এমন অবস্থায় সরকারের পাশাপাশি প্রত্যেকের নিজেস্ব অবস্থান থেকে অসহায় শ্রমজীবী মানুষের পাশে দাঁড়ানো প্রয়োজন। যারা লজ্জায় খাদ্য সাংকটের কথা বলতে পারে না তাদের খোঁজ নেওয়া উচিত। সরকারের উপর সকল দায় চাপিয়ে না দিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সাবার সচেতন হতে হবে। ইনশাল্লাহ, অাঁধার কেটে আবার আসবে নতুন এক সকাল।
শামীম শিকদার
সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
Leave a Reply