যাদের আত্ম বলিদানে আমাদের প্রিয় স্বাধীনতা, রক্তে মাখা লাল সবুজের পতাকা, তাদের কথা কয় জন মনে রাখে? সময় বদলানোর সাথে হারিয়ে যায় তারা। গাজীপুরের কাপাসিয়ার এমনই একজন স্বাধীনতার বীর সেনানী শহীদ ইব্রাহীম। তিনি ছিলেন আমার সহযোদ্ধা স্বাধীনতার অতন্দ্র প্রহরী বীর। উপজেলার পাপলা চামুরখী গ্রামের মৃত ওয়াসিন খাঁর ছেলে ইব্রাহীম ছিলেন ছিলেন ঢাকা সেনানিবাসে। ১৯৭০ সালে মুজাহিদে যোগদান করেন।
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চে জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযুদ্ধের ডাক শোনার পর থেকে সারা পূর্ব পাকিস্তান উত্তাল হয়ে উঠেছিল। সেই উত্তাল তরঙ্গে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথুরিয়া পর্যন্ত দল, মত, জাতী, ধর্ম নির্বিশেষে এদেশের কৃষক, শ্রমিক, কামার, কুমার,জেলে, তাঁতি সর্বস্তরের মুক্তিকামী মানুষ মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়েছিলো। ১৯৭১ সালের ১৯ শে মার্চ পাকিস্তানি বিগ্রেডিয়ার জেনারেল জেওয়ান জেব জয়দেবপুরের সমরাস্ত্র কারখানা ও টাকশাল নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য ও বাঙ্গালী ইপিয়ার, ন্যাশনাল সার্ভিসের জওয়ানদের হত্যা করে নিরস্ত্র করার জন্য ঢাকা থেকে জয়দেবপুর রওনা হয়। এই সংবাদ জয়দেবপুরে ছড়িয়ে পড়ল। তখন নেতৃত্বে জয়দেবপুরের কৃতি সন্তান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক বীর মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ্ব এ্যাডঃ আ.ক.ম মুজাম্মেল হক সাহেব। জয়দেবপুর থেকে চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত হাজার হাজার মুক্তিকামী মানুষ প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করেন। সেদিন স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে সারা জয়দেবপুর। এখান থেকেই সর্বপ্রথম বাংলাদেশ নামক দেশটির জন্য জয়ধ্বনি দেওয়া হয়। জয়দেবপুরের পথ ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো। তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা।
তার এক সপ্তাহের মধ্যে ২৫ শে মার্চ দিবাগত রাত্রিতে পাকিস্তানি হায়েনার দল রাতের আধারে নিরস্ত্র বাঙ্গালীর উপর ঝাঁপিয়ে পরে এবং নির্মমভাবে হত্যাযজ্ঞ চালায়। পিলখানা রাজারবাগ পুলিশ ক্যাম্প ও ইউনিভার্সিটিসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে বৃষ্টির মতো গুলি চালিয়ে বাঙ্গালী জওয়ান এবং সাধারণ মানুষ কে নির্বিচারে হত্যা করে। ২৬ শে মার্চ দিবাগত রাতে বীর শহীদ ইব্রাহীম দুটি থ্রি নট থ্রি রাইফেল নিয়ে জীবন বাজী রেখে পালিয়ে আসে। পরবর্তীতে যুদ্ধকালীন কোম্পানি কমান্ডার হেমায়েত উদ্দিন (হেমায়েত ভাইয়ের অধীনে) বীর বিক্রমে সম্মুখ যুদ্ধ করতে করতে পাক বাহিনীর বুলেটের আঘাতে ঝাঁঝরা হয়ে কাতরিয়ে কাতরিয়ে মৃত্যু বরণ করেন (শহীদ হন) দুর্ভাগ্যবশত হেমায়েত ভাইয়ের কাছে শহীদ ইব্রাহীমের কোন প্রকার ঠিকানা না থাকায় দীর্ঘকাল তার নাম শহীদের তালিকায় আসেনি। প্রায় ২০ বছর পর অনেক খোঁজ-খবর নিয়ে আমি নিজেই হেমায়েত ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করি এবং শহীদ হওয়া ইব্রাহীমের প্রত্যয়ন পত্র নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের এম.ডি ক্যাপ্টেন জয়নাল উদ্দিন সাহেবের সাথে কথা বলি। পরে শহীদের তালিকায় নাম আনা হয়।
ইতিমধ্যে শহীদ ইব্রাহীমের বৃদ্ধ মাতা পরলোক গমন করেন। তারপর থেকে তাহার অলি-ওয়ারিশগণ ভাতা ও অনুদান নিয়ে টানাটানি শুরু করেন। আনুমানিক বিগত ১৫ থেকে ২০ বছর আগে ২০ হাজার টাকার একটি অনুদান চেক, ব্যাংকে গচ্ছিত রাখার জন্য একটি একাউন্ট করতে গিয়ে ইব্রাহীমের একমাত্র ভাতিজা রতনকে নমিনি থেকে বাদ দিয়ে ভাগিনা আলতাফ হোসেন নমিনি হন। টাকা জমা হওয়ার খবর পেয়ে রতন বীর মুক্তিযোদ্ধা লেহাজ এবং হামিদকে সাথে নিয়ে ব্যাংকে যায়। টাকা উত্তোলনে বাধা প্রদান করে। তার কিছুদিন পরে ভাগিনা আলতাফ হোসেনও মৃত্যুবরণ করেন। যে টাকা ব্যাংকে জমা ছিল তা ছিল শহীদ ইব্রাহীম স্মৃতি সংসদের নামে। শহীদ ইব্রাহীমের পরিবারের সাথে কুশল বিনিময়ের জন্য যাই ও সামান্য ঈদ উপহার দিয়ে ইব্রাহীমের স্মৃতি সংসদের জরাজীর্ণ অবস্থা পরিরক্ষণ করি। আমি উপজেলা কমান্ডার থাকা অবস্থায় কাপাসিয়া উপজেলার ১১টি শহীদ পরিবারের নামে রাস্তার নাম-ফলক লাগাই। তৎকালীন কাপাসিয়া উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সেই সময়ে শহীদ ইব্রাহীমের নামে পাপলার রাস্তায় নাম-ফলক লাগানো হয়েছিলো। সেই সমস্ত রাস্তার নাম-ফলক গুলো আজ পর্যন্ত কোথাও নাই। বিগত দুই বৎসরের মধ্যে কাপাসিয়া উপজেলার সম্মানিত নির্বাহী কর্মকর্তা জনাব ইসমত আরার উদ্যোগে শহীদ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নামে নাম-ফলক লাগানো হয়েছে। তার মধ্যে শহীদ ইব্রাহীমের নাম-ফলকটি আমি পাপলার মোড়ে দেখতে পাই।
যাই হোক শহীদ পরিবারের সদস্য হিসেবে শহীদের একমাত্র ভাতিজা মোঃ রতন মিয়া চরম নাজুক অবস্থায় জীবন যাপন করছে। সে এখন রিকশা চালিয়ে দিন আনতে দিন খায়। পাশাপাশি ইব্রাহীমের স্মৃতি সংসদের টিনসেড ঘরটিও জরাজীর্ণ অবস্থায় অবহেলিত হয়ে পরে আছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক ঘোষিত বাংলাদেশের সকল মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকে জানি, মুক্তিযুদ্ধকে জানি শীর্ষক সেমিনারের নীতিমালা প্রণয়ন করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের মুখ থেকে স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস জাতির কাছে তুলে ধরা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অবহিত করার জন্য। সেই সকল সেমিনারে আমিও অনেকগুলো প্রতিষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলাম। সেই সুবাদে আমরা বাংলাদেশের প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা গর্বিত হয়েছি। প্রকাশ থাকে যে, শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা তাদের বুকের তাজা রক্ত দিয়ে আমাদেরকে স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন। যার জন্য আমার সহযোদ্ধার রক্তে মাখা লাল সবুজের পতাকা বাংলাদেশের মাটিতে পতপত করে উড়ছে। তাদের রক্তের ঋণ শোধ করার জন্য আমাদের কি কোন দায়িত্ব নেই? পক্ষান্তরে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে যিনি নিরলস-ভাবে সকল চাওয় পাওয়ার ঊর্ধ্বে থেকে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাহার কথার বাস্তবতার মিল রাখেননি প্রত্যন্ত অঞ্চলের দলীয় কিছু জোয়ারে ভাসা কর্মী। দশরত্ন বঙ্গবন্ধু কন্যা যখনই জাতীর উদ্দেশ্যে মিডিয়ায় কথা বলেন বঙ্গবন্ধুর পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানের সহিত স্মরণ করেন। যখনই দেখি কিছু কর্মীরা ক্ষমতার দাপটে গা ভাসিয়ে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের কটাক্ষ করে এবং দুই-নম্বর মুক্তিযোদ্ধাকে পারলে কোলে বসিয়ে রাখেন। তখনই মনে হয় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার কোথাও ফাঁক থেকে যাচ্ছে। আমরা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা বঙ্গবন্ধুকে বুকে ধারণ করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নই দেখি। বীর শহীদদের রক্তমাখা লাল সবুজের পতাকা সমুন্নত থাকুক সর্বকাল, চিরঞ্জীবী হোক বাংলার রাখাল রাজা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
সাবেক উপজেলা কমান্ডার
কাপাসিয়া,গাজীপুর।
Leave a Reply