করোনায় হু হু করে কাঁদছে গোটা পৃথিবী। কোথাও কোনো স্বস্তি নেই, নেই মানসিক শান্তি। সবই যেনো শাস্তি। করোনায় পজিটিভ রোগীদের পোহাতে হচ্ছে নানান কটুক্তি আর অবহেলার শিকার। নানান প্রতিবন্ধকতা মাড়িয়ে অনেকে জয় করে উঠছেন প্রাণঘাতী এই ভাইরাসকে। তেমনই একজন নাজমুল হুদা। পড়ছেন রাজধানীর তিতুমীর কলেজে।পাশাপাশি গণমাধ্যম কর্মী হিসেবেও কাজ করছেন। মাত্র ২০ দিনে করোনা জয় মোকাবিলা করে সুস্থ্য হয়ে উঠেছেন তিনি। চলুন জানি তার গল্পটা কেমন ছিলো-
করোনা পরিক্ষার জন্য আইইডিসিয়ারে কল করলে ২৭ এপ্রিল আমার নমুনা সংগ্রহ করেন। তবে এর আগের দিন ২৬ মার্চ আমি এক সহকর্মীকে নিয়ে মুগদা হসপিটাল যাই। সেখানে আমরা দু’জন নমুনা দিয়ে আসি। পরদিন আমার ওই সহকর্মীর করোনা পজিটিভ রিপোর্ট আসে। আমার কোনো রিপোর্ট আসে না। পরিক্ষা করানোর সময় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলেছিলো ২৪ ঘন্টার মধ্যে যাদের ফোনে রিপোর্ট (খুদে বার্তা) না যাবে তারা নেগেটিভ তথা করোনায় আক্রান্ত না। এরপর আমি আর আমার রিপোর্ট পাইনি। তখন অফিসে ওই করোনা পজিটিভ সহকর্মীও আর আমি সহ আরও দু’জন একসঙ্গে অফিসে ছিলাম। তবে এটা বেশ ঝুকিপূর্ণ মনে হয়েছিলো বিধায় আমি কর্মস্থল ত্যাগ করে বাসায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। পরে ৩০ তারিখ আবার ২য় বার হাসপাতালে যাই এবং নমুনা পরিক্ষা করতে দেই। আর ওই হাসপাতালে আমার আগের রিপোর্টের সন্ধান করি। কিন্তু কর্তৃপক্ষ আমার রিপোর্ট খুজেই পায়নি। এরপর সেখান থেকে বাসায় যাই। এবং হোম কোয়ারেইন্টাইন মেনে পরিবারের সবাইকে সতর্ক করি।
বাসায় আসার পর আমার হালকা গলা ব্যথার উপসর্গ অনুভব হচ্ছিলো। যা দেখে আমি ধারণা করেছিলাম হয়তো আমিও আক্রান্ত। এরপর ২ তারিখে আমার ঘুম ভাঙলে মোবাইলে একটা মেইল পাই। আর সেখানে আমার করোনা পজিটিভ ধরা পরার রিপোর্ট পাই। তখন আমি আমার পরিবারকে জানাই আর তাদের আমার বড় আপুদের বাসায় স্থানান্তর করার চেষ্টা করি।
এর জন্য স্থানীয় কাউন্সিলরের সহযোগিতা নেই৷ এবং পরদিন আপুদের গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে ওই খালি ফ্লাটে আমার পরিবারের মা, ভাই আর বোনকে পাঠাই। কিন্তু সেই মূহুর্তে এলাকার স্থানীয়রা আপুদের বাড়িতে আমার পরিবারকে উঠতে দেয় না। তাদের আমার এখানে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। এবং আমাদের ঘর আর বাড়ি বাইরে দিয়ে তালা লাগিয়ে দেয় এবং আমার জানালা আটকিয়ে দেয়। তখন আমি পরিবারকে নিরাপদ কোয়ারেইন্টাইনে রাখতে স্থানীয় প্রশাসন এবং কাউন্সিলরের সহযোগিতা নেই৷ এবং অনেক কাটখোট্টা পুড়িয়ে তাদের ওই বাসায় পাঠাতে সক্ষম হই।
এদিকে, আমার ভিতরে করোনার তেমন কোনো উপসর্গ ছিলনা। তাই আমি চাইলে তথ্য গোপন দিব্যি ঘুরে বেড়াতে পারতাম। এলাকায় ছড়িয়ে দিতে পারতাম এর সংক্রমণ। কিন্তু আমি আমার এলাকার মানুষজনকে নিরাপদ রেখেছি। এবং আমার পরিবারকে নিরাপদ রাখতে চেয়েছি। কিন্তু আমার সমাজের মানুষজন উল্টো আমার পরিবারকেই বিপদে ফেলতে চেয়েছে। আমাদের দুইটি রুমের জন্য একটি ওয়াশরুম৷ একটি রান্নাঘর। এটিই আমি সহ পরিবারের বাকিদের ব্যবহার করতে হত। যা খুবই ঝুকিপূর্ণ বিধায় আমি তাদের নিরাপদে রাখতে চেয়েছিলাম। আর এর জন্য আমাকে মানসিক চাপ পেতে হয়েছে অনেক। এবং সেদিন আমি মানসিক ভাবে এবং শারীরিক ভাবেও দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম।
হোম আইসোলেশনের সময়টা ছিলো ২৭ এপ্রিল থেকে ১৬ মে। করোনাভাইরাসে আমার উপসর্গ ছিল খুবই কম। সামান্য জ্বর আর গলা ব্যথা ছিল। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের থেকে পরামর্শ নিয়ে ঘরে বসেই নিয়েছিলাম কিছু মেডিসিন আর টোটকা।করোনা আক্রান্ত জানার পরেও মানসিক ভাবে ভেঙে পড়িনি। করোনা থেকে ছিলাম পুরোপুরি আতঙ্কমুক্ত। পরিবারকে নিরাপদে হোম কোয়ারেইন্টাইনে পাঠিয়েছি। এরপর শুরু হয়েছে ঘরে একা থাকার প্রহর গণনা। তবে পুরোপুরি একা ছিলাম না। সঙ্গে ছিলো স্মার্ট ফোন। একা মনে হলে এটাকেই ব্যবহার করতাম সময় কাটানোর সঙ্গি হিসবে। ডাক্তাররা বলতেন, সবসময় চিন্তামুক্ত থেকে হাসিখুশি থাকতে। তাই মোবাইলে বন্ধু বা আত্মীয়দের সঙ্গে কথা বলেছি। এছাড়া, বিভিন্ন নাটক বা ছবি দেখে ব্যস্ত সময় পার করেছি।
যদি শরীরে হালকা জ্বর অথবা গলাব্যথা হতো তখন শুধু নাপা খেয়েছি আর লবন মিশ্রিত কুসুম গরম পানি দিয়ে গড়গড়া করেছি। প্রতিদিনই চেষ্টা করতাম ৩/৪ বার এটি করতে। এছাড়াও সব সময় গরম পানি খেয়েছি, আদা, লং, দারচিনি, এলাচ আর কালোজিরে দিয়ে রং চা খেয়েছি। এবং মাঝে মধ্যে শ্বাস নিয়েছি গরম পানি দিয়ে। দিনে অন্তরে ৩/৪ বার এটি করার চেষ্টা করেছি। গোসল করেছিও কুসুম গরম পানি দিয়ে। সঙ্গে জীবানুনাশক হিসেভে স্যাভলন ব্যবহার করেছি। পরিষ্কার থাকার চেষ্টা করেছি সব সময়। যখনি মনে হতো সাবান দিয়ে হাত ধোয়া দরকার তখনি ধুতাম। যদি মাঝে মধ্যে দু-একটা হাচি বা কাশি আসতো তবে তখন টিস্যু ব্যবহার করতাম এবং সঙ্গে সঙ্গে হাত সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলতাম।
শ্বাসকষ্ট সমস্যা না থাকলেও আমি ডাক্তারের পরামর্শ মত শ্বাসের ব্যায়াম করেছি দিনে তিনবার। পর্যাপ্ত ঘুমিয়েছি এবং মাঝে মধ্যে ঘরের মধ্যে হাটাচলা এবং ব্যায়াম করেছি। পর্যাপ্ত পরিমানে পানি পান করেছি। ভিটামিন সি জাতীয় খাবার খেয়েছি। বিশেষ করে লেবুটা আর পেয়ারা বেশি খেয়েছি। এবং শরীরের কোনো পরিবর্তন দেখা দিলেই ডাক্তারের সাথে কথা বলেছি এবং পরামর্শ নিয়েছি। পরিশেষে করোনাকে জয় করে ঈদের হাসি ঈদের আগেই হেসেছি।
প্রতিদিনের কথা: প্রিয় নাজমুল হুদা, করোনাকে হারিয়ে সুস্থ হয়ে ফিরেছেন আপনি, জিতেছেন অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে অসম্ভব এক লড়াইয়ে। আপনার লেখা এই বিজয়ের গল্প অনুপ্রেরণা যোগাবে আরও হাজার হাজার মানুষকে। অনেকের প্রিয় খেলোয়াড় রজার ফেদেরার, টানা সাড়ে চার বছর কোন গ্র্যান্ডস্ল্যাম জেতেননি তিনি, সবাই ধরে নিয়েছিল ফেদেরার ফুরিয়ে গেছেন। ২০১৭’র অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জিতে ফিনিক্স পাখির মতো ফিরেছিলেন ফেদেরার, সেরকমই ফিরে আসার একটা রূপকথা লিখে ফেলেছেন আপনি নিজেও। প্রতিদিনের পরিবারের পক্ষ থেকে আপনাকে অভিনন্দন, আপনার জন্যে ভালোবাসা। খুব শিগগিরই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে একদম স্বাভাবিক জীবন শুরু করবেন আপনি, এটাই আমাদের কামনা…
Leave a Reply