বিশেষ প্রতিনিধিঃ-
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের এখন বেহাল দশা। গত তিন মাস ধরে বন্ধ ওপেন হার্ট সার্জারি, বন্ধ রয়েছে হার্টে রিং পরানো, পেসমেকার বসানো, এনজিওগ্রাম ও ইটিটি করা, স্থবির হয়ে পড়েছে উন্নয়ন কার্যক্রম। হাসপাতালের সিনিয়র অধ্যাপক ও ইউনিট প্রধানরা নিয়মিত হাসপাতালে আসছেন না, এমনকি শীর্ষ পর্যায়ের চিকিৎসক নেতারা এবোরেই আসছেন না হাসপাতালে। এই হাসপাতালটি করোনা চিকিৎসার জন্য না হলেও ইতিমধ্যেই দেড় শতাধিক চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। সব মিলিয়ে দেশের হৃদরোগের সবচেয়ে বড় এবং একমাত্র বিশেষায়িত হাসপাতালটির এখন বেহাল স্থবির হয়ে পড়েছে। রোগীরাও আগের মতো কাক্সিক্ষত সেবা ও চিকিৎসা পাচ্ছেন না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনা পরিস্থিতির শুরু অর্থাৎ গত মার্চ মাস থেকেই জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চলছে চরম অব্যবস্থাপনা। দেশের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে আসা সাধারণে রোগীরা এখন আর এখান থেকে তেমন কোন চিকিৎসা পাচ্ছেন না। প্রতিদিন শত শত রোগী নানা ধরনের চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছে। হাসপাতালটিতে আগে যেখানে প্রতিদিন ৪/৫ টি ওপেন হার্ট সার্জারি, ১৫/২০টি এনজিওগ্রাম এবং ৩০-৪০টি স্ট্যান্টিং (হার্টে রিং পরানো) হতো, সেখানে এখন সবই বন্ধ রয়েছে। সার্জারির কোন সেবাই পাচ্ছে না এখন রোগীরা। হাসপাতালের সিনিয়র অধ্যাপক ও ইউনিট প্রধানরা প্রায় তিন মাস ধরেই হাসপাতালে আসছেন না। আসছেন না হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসক নেতারাও। বেশিরভাগ ডাক্তার ও ইউনিট প্রধানরা হাসপাতালে না এসেই ইতিমধ্যেই দেড় শতাধিক ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। ফলে জুনিয়র ডাক্তাররা কোন রকমে চালু রেখেছে হাসপাতালের কার্যক্রম।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের কয়েকজন জুনিয়র ডাক্তার স্বদেশ প্রতিদিনকে জানান, মূলত হাসপাতালটির ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়েছে। এখানে এডমিনিস্ট্রেশন বলতে কিছু নেই। কেউ কারো কথা শোনে না। ফলে সিনিয়র ডাক্তারদের কেউ-ই হাসপাতালে আসছেন না। ইউনিট প্রধানরা মাসের পর মাস অনুপস্থিত থাকাও ওইসব ইউনিটের কাজকর্ম অচল হয়ে পড়েছে। প্রশাসনের দুর্বলতার কারণে হাসপাতালের স্টেচার ইনচার্জ ও ফার্মাসিস্ট পরস্পর যোগসাজস করে হাসপাতালের দেড় লক্ষাধিক টাকার ওষুধ চুরি করে সরকারের গোয়েন্দাদের হাতে আটক হয়েছে। তারা বলেন, জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালটিকে আরও উন্নত ও অত্যাধুনিক করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক সহযোগিতায় যে উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছিল সেগুলোও মুখ থুবড়ে পড়েছে। এক কথায় হৃদরোগ চিকিৎসায় দেশের একমাত্র বিশেষায়িত হাসপাতালটি এখন সব দিক থেকে একটি ব্যর্থ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
সরেজমিনে হাসপাতালটিতে ঘুরে দেখা গেছে, ৪ মাস আগেও যেখানে হাসপাতালটিতে প্রতিদিন প্রায় এক হাজার রোগী ভর্তি থাকতো, প্রতিটি ওয়ার্ড, বারান্দা, কড়িডোরে থাকতো রোগীর অতিরিক্ত বিছানা, সেখানে এখন অনেক ওয়ার্ডই খালি পড়ে আছে। অপারেশন থিয়েটার ও ক্যাথ র্যাব এলাকা ফাঁকা। কথা হলো ৫ নম্বও ওয়ার্ডেও মহিলা রোগী জমিলা খাতুনের সাথে। তিনি মুন্সীগঞ্জ থেকে ৫ দিন ধরে এসছিলেন হার্টে রিং পড়ানোর জন্য। কিন্তু তাঁকে কোন অধ্যাপক (তার ভাষায় বড় ডাক্তার) দেখেননি এবং ওয়ার্ডবয় জানিয়েছে রিং পড়ানো বন্ধ রয়েছে। তাই তিনি চলে যাচ্ছেন। প্রায় ৭০ বছরের বৃদ্ধ আলীমুদ্দিন মিয়া এসেছিলেন গাজীপুর থেকে। তিনিও আউটডোর থেকেই ফিরে গেলেন হাসপাতালের অবস্থার কথা শুনে। হাসপাতালের বর্তমান অবস্থা নিয়ে কর্তব্যরত কোন জুনিয়র ডাক্তারই কথা বলতে রাজি হলেন না। কর্মচারিদের কেউ কেউ দুচার কথা বললেও, তারা অজানা ভয়ে শঙ্কিত থাকেন। সত্য কথা বললে নাকি চাকরি চলে যেতে পারে।
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীর জামাল উদ্দিনের সঙ্গে কথা বলার জন্য একাধিকদিন হাসপাতালে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি এবং তার মোবাইলে বার বার ফোন দিলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।ওষুধ পাচার
জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট থেকে ওষুধ পাচারের সময় হাতেনাতে ধরা পড়েন প্রতিষ্ঠানের একজন ফার্মাসিস্ট ও একজন স্টোর ইনচার্জ। ওই ফার্মাসিস্টের নাম নির্মল সরকার। আর স্টোর ইনচার্জের নাম হল বশির উদ্দিন। জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআইয়ের সদস্যরা তাদের আটক করেন।
বিষয়টি নিশ্চিত করে শেরেবাংলানগর থানার এসআই জহিরুল ইসলাম বলেন, ফার্মাসিস্ট নির্মল ও স্টোর ইনচার্জ বশির হাসপাতাল থেকে প্রায় দেড় লাখ টাকা মূল্যের ২০০ ধরনের ওষুধ মাত্র ৫০ হাজার টাকায় পাচার করছিল। এ সময় গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআইর সদস্যরা তাদের হাতেনাতে আটক করেন। পরে থানায় খবর দিলে পুলিশ তাদের থানায় নিয়ে আসে।
শেরেবাংলানগর থানার এসআই তৌহিদুল ইসলাম বলেন, এ বিষয়ে এনএসআইয়ের পক্ষ থেকে থানায় একটি অভিযোগ দেয়া হয়েছে। এ বিষযয়ে একটি মামলাও হয়েছে। এনএসআই জানিয়েছে, আটকরা দীর্ঘদিন ধরে সরকারি ওষুধ পাচার করে বাইরে বিক্রি করছিল বলে অভিযোগ ছিল। এ অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযান চালানো হয়।
Leave a Reply