২০১২ সাল, পবিত্র রমযান মাস। টিভিতে কিছু একটা দেখব বলে টিভি অন করলাম। হঠাৎ একটি নিউজ চ্যানেলে এসে আটকে গেলাম।
“কান্নার জোয়ারে ভাসছে দেশ,অশ্রুসিক্ত ঢাবি প্রাঙ্গণ। প্রিয় লেখককে শেষ বারের মত শ্রদ্ধা জানাতে ঢাবিতে লাখো মানুষের ঢল”। হঠাৎ একটা বাচ্চা ছেলের সাক্ষাৎকার দেখাল। ছেলেটা কাঁদো কাঁদো গলায় বলছে, “স্যারের বই খুব প্রিয় ছিলো। ভাবতেও পারছি না যে স্যার আর কোন নতুন বই লিখবেন না।প্রিয় মানুষকে শেষ বারের মত দেখতে এসেছি”।আমি একটু অবাক হলাম এই ভেবে যে একজন লেখকের জন্য বাচ্চার মনেও এত আকুতি!! তাছাড়া কেউ অমর নয়।। জন্মিলে মরিতে হবে এটাই নিয়ম।লেখকরাও এই নিয়মের বাইরে না।তাছাড়া লেখক তো ছেলেটার আপন কেও না। তবে কাঁদছে কেন? দেশের একজন নামকরা কথাসাহিত্যিক ছিলেন হুমায়ুন আহমেদ। উনি বিদেশের একটি হাসপাতালে মারা গেছেন। উনার লাশ দেশে আনা হয়েছে।তখন হুমায়ুন আহমেদ সম্পর্কে এইটুকুই ছিলো আমার ধারণা!
যাহোক, হুমায়ুন সাহিত্যের সাথে আমার প্রথম পরিচয় ২০১৫ সালে ‘হিমুর রুপালী রাত্রি’র মাধ্যমে।হিমু চরিত্রটি এতই আকর্ষণ করল যে ওইদিনই নেট থেকে হিমু সিরিজের সব বই ডাউনলোড করে ফেললাম।
তারপর একে একে পরিচয় হল মিছির আলী ও শুভ্রর সঙ্গে। তারপর পড়লাম কৃষ্ণপক্ষ,রুপা,নবনী,তিথির নীল তোয়ালে,লীলাবতী,দীঘির জলে কার ছায়া গো,বৃষ্টিবিলাস এর মত সাড়া জাগানো উপন্যাসগুলো।এখনো মনে আছে বৃষ্টিবিলাস বইটার জন্য পুরো ময়মনসিংহ শহরের সব লাইব্রেরি খুঁজে বেরিয়েছি। আর এই বইটার গল্প যে কত মানুষের কাছে বলেছি, বইটা সাজেস্ট করেছি তার কোনো ইয়ত্তা নেই।প্রায়ই শামা, লীলা, তিথিদের মাঝে নিজেকে খুজে পাই।মন খারাপ হলে হিমু পড়ি আচমকা মন ভালো হয়ে যায়।
শুধু তাই না,বিভিন্ন সময়ের সঙ্গী হয়েছে হুমায়ুন আহমেদের নাটক, সিনেমা। ম্যাজিকেল পাওয়ার নিয়ে নির্মিত হুমায়ুন আহমেদের ‘দুই দুয়ারী ‘ সিনেমাটি আমাকে প্রেরণা দিয়েছে জীবন নিয়ে নতুন করে ভাবতে।এই সিনেমার মাধ্যমে তিনি জানিয়েছেন বিশ্বাসের অপরিসীম শক্তি সম্পর্কে। নন্দিত নরকে, শঙখনীল কারাগার চন্দ্রকথা, শ্রাবণ মেঘের দিন সিনেমাগুলোও অনেক গুরুত্বপূর্ণ মেসেজ দেয় সমাজকে।
বাকের ভাইয়ের ফাঁসি যাতে না হয় সেই দাবিতে ঢাকা শহরে মিছিল হয়েছিল।এক সময়ের তুমুল জনপ্রিয় চরিত্র। যা হুমায়ুন আহমেদরই সৃষ্টি। এই করোনালগ্নে বাংলাদেশ টেলিভিশনে নিয়মিত প্রচারিত হচ্ছে হুমায়ুন আহমেদের নাটকগুলো!
বিনোদন, হিমু,প্রেম,অনুপ্রেরণা সবই তো হল তাহলে পড়াশোনাটা বাদ যাবে কেন???
মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লিখা হুমায়ুন আহমেদের ‘জোছনা ও জননীর গল্প’ বইটি সাহায্য করেছে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বিশদভাবে জানতে।
এক পর্যায়ে ইচ্ছা হল ব্যক্তি হুমায়ুন সম্পর্কে জানতে। তাই ভাবলাম উনার লেখা ‘আমার ছেলেবেলা’ বইটি দিয়েই শুরু করব।তবে বইটি পড়ার আগে মনে হল, ইশ যদি উনার সাথে একটা মিল খুঁজে পেতাম নিজের!!! পেয়েও গেলাম ২ টা মিল।
হুমায়ুন আহমেদ নিয়ে এতই মগ্ন ছিলাম যে একদিন স্বপ্নেও দেখে ফেললাম উনাকে।আমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছেন।আমার কাছে একগ্লাস বরফ দেওয়া পানি চাইলেন। অনেক গল্প করলেন।একপর্যায়ে আমাকে নিয়ে একটা বই লেখার জন্য উনাকে অনুরোধ করলাম। উনি বললেন,”যদি সুযোগ হয় অবশ্যই লিখব”।আমি তো মহাখুশী।
ঘুম ভাঙতেই মনে হলো, না এই দুনিয়ায় নতুন কোনো বই লিখতে আর কোনোদিন ফিরে আসবেন না আমাদের প্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদ।কিন্তু এই যে আমাদের আবেগ অনুভূতিতে মিশে আছেন যিনি তাকে কি প্রয়াণের পরেই ভূলে যাওয়া সম্ভব? না,, সম্ভব না।আজও তিনি মিশে আছেন আমাদের জোছনা কিংবা বৃষ্টিবিলাসে! মিশে আছেন তার সৃষ্টি উপন্যাসে! সেদিনের সাক্ষাৎকার দেওয়া সেই বাচ্চা ছেলেটার কষ্ট আমি এখন অনুভব করতে পারি।এখন মনে হয় ইশশ যদি এখনো বেচে থাকতেন!!! নতুন বই পেতাম, অটোগ্রাফ নিতে যেতাম।কিছু শূন্যতা, কিছু আফসোস, কিছু কষ্ট অজান্তেই এসে মনে ভীড় করে।
হুমায়ুন আহমেদ উনার লীলাবতী উপন্যাসে লিখেছিলেন, “মানুষ পুরোপুরি চলে যায়না।কিছু না কিছু রেখে যায়।” উনিও মায়া রেখে গেছেন। আর সেই মায়ার টানেই বুঝি হাজারো মানুষ ছুটে আসেন অন্যধারা,অনন্যার স্টলগুলোতে।আর খুঁজে ফেরেন প্রিয় লেখকের স্মৃতি!!
লেখকঃ শিক্ষার্থী, রসায়ন বিভাগ
সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা।
Leave a Reply