আজ শ্রাবণ সন্ধ্যায় জামালপুরের বাসায় অঝোর ধারায় ঝরে পড়া টিনের চালে বৃষ্টির ছান্দসিক শব্দে মনটা কেবলই উদাস বনে যাচ্ছে….
খেয়ালী বর্ষা এসেছে ভাঙ্গা – গড়ার অনিবার্য শৈলী শিল্পী হয়ে মানব মনে প্রশান্তির অবিরল ধারায় স্মৃতির সীমানায় অবগাহনের অঙ্গীকারে ঋদ্ধ সময়ের আবেদন ছুঁয়ে ছুঁয়ে । মনে পড়ছে ফেলে আসা দুর্দান্ত সেসব সোনালি দিনের গল্প ।
সহজাতভাবেই মানুষ বিস্মৃতিপ্রবণ । পুরনো স্মৃতিগুলো চলার পথের নব নব আয়োজনের ধূলোবালির আস্তরণ পড়ে ম্লান হয় বলেই চঞ্চল মানুষ সামনে বাড়তে শিখে , এগিয়ে চলার সাহস পায় । তবুও কিছু স্মৃতি , কিছু অনুভূতি কখনোই পুরনো হয় না বরং আপন মহিমায় দ্যুতি ছড়ায় , ভাবায় , হাসায় – কাঁদায় ।
অনেকের কাছে আমি কিশোরগঞ্জের কিশোরী হলেও আজন্ম লালিত যে শহরের সবুজ শ্যামলিমার প্রাণ প্রাচুর্যে আমি জন্মেছি বেড়ে উঠেছি , স্কুল – কলেজের গন্ডি পেরিয়েছি সেটি আমার প্রাণের প্রিয় শহর জামালপুর । অবসর প্রাপ্ত বাবার ঘরে কলেজের পাঠ শেষ হওয়ার পূর্বেই কিছু বুঝে না বুঝে ওঠার আগেই প্রাক- প্রেমের ঘোর নিয়ে কিশোরী বয়সেই বিয়ের পিঁড়িতে বসা । শুরু হয় কিশোরী কন্যার সংসারধর্ম , পড়াশুনা – সন্তানপালনের গুরু দায়িত্ব। অবশেষে সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে শিক্ষা ক্যাডারে যোগদান । জীবনটাকে জটিল এক সংসারে থিতু করলেও যাপিতজীবনে সুখ , দুঃখের ভেলায় ভেসে রঙিন প্রজাপতির মতোই পুরো জামালপুর মাতিয়েছি মনের রঙে রাঙিয়ে । বহতা সময়ের রাশ টেনে আনন্দ উপভোগ করেছি স্বজন – পরিবার – পরিজন , বন্ধু – পরিচিতজনদের সাথে । সে স্বাধীনতা আমার উদারমনা স্বামী জনাব হাসমত আলী চৌধুরী আমাকে যেমন দিয়ে রেখেছিলেন তেমন তিনি নিজেও সেসব উপভোগ করতেন । জামালপুরে সরকারি জাহেদা সফির মহিলা কলেজে চাকুরীর সুবাদে কলেজ আর বাড়ির পার্থক্য করা ছিলো বড়োই কঠিন । কলেজ ক্যম্পাস , সহকর্মীদের সাথে সময় কাটানো , ঘরে বাইরে আড্ডাবাজী , থানা , কোর্ট – কাচারী থেকে শুরু করে স্কুল কলেজ , ডিসির অফিস , হসপিটাল সবখানে ছিলো আমার অবাধ বিচরণ । এক কথায় বাঁধনহারা – ছন্নছাড়া আমি ।
একদিনও যদি কখনও বাইরে বেরোনোর সুযোগ না হতো তাহলে নিজেই অবাক হয়ে যেতাম ; কৌশল করে একটা না একটা কাজ বের করে নিতাম …. স্বেচ্ছাশ্রম দিয়েছি মনের আনন্দে ; তাছাড়া পাবলিক হলে , শিল্পকলায় – সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে আমার সরব উপস্হিতি ছিলো দৃশ্যমান । সর্বমহলে যেমন আদরণীয় গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছি তেমনি ভালোবাসা আর মর্যাদায় আপ্লুতও হয়েছি । মহান একুশের প্রভাতফেরী করেছি তিন বাচ্চাকে সাথে নিয়ে ; মহান স্বাধীনতা আর বিজয় দিবসের প্যারেড গ্রাউন্ডে ধারাবিবরণী থেকে শুরু করে বাচ্চাদের স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদিতেও অংশগ্রহণ করেছি গভীর আগ্রহে আর উৎসাহে । মুক্ত বিহঙ্গের মতো বিচরণ করেছি বাবুর বাবার সাথে কখনও বা বাসায় না বলেই বাইক – রাইডে লং ড্রাইভে । অবশ্য , সামাজিক পরিচিতির এসব কারণও রয়েছে । বাবুর বাবার জনপ্রতিনিধিত্বের দীর্ঘ একটা সময়ে জামালপুরে এমন একটা ক্ষেত্র যেমন তৈরি হয়েছে তেমনি আমি স্হানীয়ভাবে শিক্ষক হিসেবেও সামাজিক মর্যাদার একটা অনিবার্য প্রভাব তো ছিলোই । এ দুয়ের মেলবন্ধন প্রিয় জামালপুরকে করেছে আমার নিজস্ব পৃথিবী । নির্ভয়ে , নিঃসংশয়ে , অসংকোচে সাহসের সাথে দিবারাত্রির কাব্য রচনা করেছি প্রিয় জামালপুর শহরে , মাটির মমতা রসে ।
পেশাগত কারণেই চাকুরীতে প্রমোশন পরবর্তী সময়ে স্টাডি লিভ নিয়ে এম ফিল , পিএইচডি করার উদ্দেশ্যেই বাচ্চাদের রেখে ২০০৭ সালে আবার পাড়ি জমালাম মেগাসিটি খ্যাত ঢাকা শহরে মানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে । গার্হস্থ্য জীবনের মাঝেই ফের শুরু হলো এমফিলের শিক্ষার্থী হিসেবে “বেগম ফয়জুন্নেছা” হলের আবাসিক ছাত্রী হয়ে পথচলা । যদিও ” রোকেয়া হল ” আমার তারুণ্যের সবুজে রাঙানো মিষ্টি খেলাঘর । সন্তানদের পড়াশুনার পাশাপাশি নিজেরটাও চলেছে সমানতালে এই জামালপুরে আসা যাওয়ার মাঝেই ।
বেড়েছে পেশাগত ব্যস্ততা , ছেলেমেয়েদের নানামুখী বিস্তৃতি , পরিবহন জটিলতা সবমিলিয়ে জামালপুরের টানে বেশ খানিকটা ভাটা পড়লেও ঢাকা ছেড়ে যখনই নিজ শহরের দিকে পা বাড়িয়েছি তখন অন্যরকম এক আনন্দে মনটা নেচে উঠেছে । বাসায় পা রাখতে না রাখতেই বেড়েছে ব্যস্ততা ; স্বজন – পরিজন , প্রতিবেশি , শহরের চেনা – অচেনা অর্ধচেনাদের ভালোবাসায় মোহিত হয়েছি বরাবরই । বাসায় চায়ের কাপে আড্ডার ঝড় উঠেছে রাতের দ্বিপ্রহর পযর্ন্তও । রঙিন সে দিনগুলি চাইলেও কী আর ফিরে পাওয়া যাবে । প্রিয় জামালপুরবাসীর কাছে ভালোবাসার এ ঋণ আমার অপরিশোধ্য । আমার তরফ থেকেও এ শহরের বাসিন্দাদের প্রতি ভালোবাসার নিবেদন অপরিমেয় ।
বৈশ্বিক মহামারীর কবলে পড়ে দীর্ঘ লকডাউন নিষেধাজ্ঞার সময়টিতে জামালপুরে আসা হয়ে ওঠেনি আমার এবং বাচ্চাদের । ওদের বাবা – বড়ো মা দুজনই অসুস্হ অবস্হায় জামালপুরের বাসায় অবস্হান করছেন । ১৬ জুলাই হঠাৎই বাবুর বাবার অসুস্হতা বেড়ে যাবার খবর পেয়ে কোনোরকম ভাবনা চিন্তা না করেই একা চলে এসেছি জামালপুরে । তিন – চার দিন বেশ ব্যস্ত ছিলাম দুই রোগীকে নিয়ে । যথাসম্ভব সতর্কতাসহ দুজনকেই নিবিড় পরিচর্যায় খানিকটা সুস্হ করতে পেরেছি বলেই মনে হচ্ছে । মনের দুঃশ্চিন্তার মেঘটাও ইতিমধ্যে সরে গিয়েছে । ছোটোবেলা থেকেই শুনে এসেছি জামালপুর এক গলির শহর যদিও বিদ্যমান সময়ে সরকারের সুদৃষ্টি এবং সাবেক বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী , বর্তমানে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জনাব মির্জা আজম ভাইয়ের আন্তরিক প্রচেষ্টায় জামালপুর এখন উন্নত জেলা শহরের তালিকায় স্হান করে নিয়েছে । দৃশ্যমান হয়েছে শহরের প্রাণকেন্দ্রে কালচারাল ভিলেজসহ শিল্পকলা একাডেমী । বলছিলাম , সেই একগলি শহরের ওপরেই আমাদের বসতবাটি । গত দু” তিন দিনে ঔষধ – পথ্য – ডাক্তারসহ প্রয়োজনীয় কাজ সেরেছি বাসা টু কথাকলি মার্কেট অথবা একটু বাড়িয়ে বললে সকাল বাজার পর্যন্ত । রেলওয়ের অনলাইন টিকিট সমস্যায় আজ সকালে সোনালি ব্যাংক হয়ে ডিসির অফিসে গিয়েছিলাম । প্রিয় শহরের পরিচিত কতো দোকান , মার্কেট , সুউচ্চ ভবন আগ্রহভরে দেখছিলাম ।
জামালপুরের কোল ঘেঁষে পুরাতন ব্রক্ষ্মপুত্রের শাখানদী প্রবাহিত । রিকসায় যেতে যেতে নদীর উপচে পড়া পানিতে প্লাবিত দু” কূল ছাপিয়ে নদী তীরবর্তী গ্রামের ঘরবাড়ি , গাছগাছালি আধডোবা হয়ে থাকা দৃশ্য চোখে পড়লো । সারাদেশেই বাড়ছে বন্যার পানি … প্লাবিত হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম । জামালপুর সদর , ইসলামপুর , মেলান্দহ , মাদারগঞ্জ সরিষাবাড়িতে পানি হু হু করে বেড়েই চলেছে ; নদীভাঙ্গনও থেমে নেই । পানি প্রবাহিত হচ্ছে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে । পানীয় জল , খাদ্য সংকটসহ ঔষধ পথ্যের অভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দুর্ভোগ চরমে । মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা কোভিড ১৯ মহামারীর পাশাপাশি বন্যাকবলিত জনদুর্ভোগকে সর্বাধিক আমলে নিয়ে বিভিন্ন সেবা সেক্টরকে নিয়মিত সেবা দেয়ার জন্য নির্দেশনা দিচ্ছেন এবং তিনি নিজে এসবের যথাযথ মনিটরিং করে চলেছেন ।
ক্ষতিগ্রস্ত প্রান্তিক জনতার জীবনাচার ভাবনার মূল কারণ হলেও দিগন্ত বিস্তৃত আকাশের কোলে জলের প্রবাহিত ধারার নান্দনিকতাপূর্ণ আনন্দ -নৃত্য সত্যিই উপভোগ্য ।
ডিসির অফিস থেকে বের হয়ে হেঁটে হেঁটে একাই নদীর পাড়ের বাঁধের ওপর দিয়ে ব্রিজে চলে গেলাম । কোনো তাড়া ছিলো না ঘরে ফেরার , ব্যস্ততা ছিলো না রান্না করার , নির্ভেজাল সময়টুকু নিজেকেই দিলাম । বিস্তর স্মৃতির আবেগঘন ওড়াওড়ি মনের পর্দাতে দেখতে পারছিলাম যেনো । চেনা নগরীর আজ অনেকেই অচেনা তারওপর মাস্কের বাড়তি সুরক্ষা সংযোজনে চেনা অচেনা সকলেই সমান । অনেকের দৃষ্টি আমি কাড়লেও আমি আমার মতোই স্রোতস্বিনী জলের তরঙ্গায়িত রুপ বৈচিত্র্যের ছবি নিচ্ছিলাম আপনমনে । দূরে গাছ গাছালির সারি সারি সবুজ সমারোহে আধাডোবা খড়ের গাদা আর ডুবন্ত বাড়িগুলোকে কোনো বিশিষ্ট শিল্পীর ক্যানভাসে আঁকা ছবির মতোন মনে হচ্ছিলো । ব্রিজের দু ” পাশের রেলিং এ শালিক পাখি আর কাক পাখির ছন্দিত বিচরণ প্রকৃতির কোলে যেনো অন্যরকম মাত্রা পেয়েছে । মাঝে মাঝে দু ” একটি ইঞ্জিন চালিত নৌকার ভট ভট শব্দেও মেঘলা গোমট আবহাওয়ায় মন্দ লাগছিলো না । মনে হলো মেঘমুক্ত আকাশে চাঁদনী রাতে এমন প্লাবিত জনপদে প্লাবিত চাঁদের বাঁধভাঙ্গা জল – জোছনার একীভূত রুপদর্শন কেবলই উপভোগ্য । সময় সুযোগ করতে পারিনি বলে সে রুপদর্শন থেকে বঞ্চিত হতে হলো । ধাবমান চন্দ্রকে ছোটোবেলায় দেখেছি মুগ্ধ হয়ে …. রুপালি জোছনার মায়াময় নরম আলোতে ভিজেছি গভীর রাত পর্যন্ত খন্ড খন্ড মেঘের লুকোচুরিতে চাঁদকে ধাবমান মনে হলেও মেঘের ভেলার অপার্থিব সৌন্দর্যে বিশ্ব প্রকৃতি যেনো ভেসে যেতো । হঠাৎ পেছন থেকে পরিচিত এক ভাই এসে ভাবী ” বলায় আমি হকচকিয়ে গিয়েছি ।
সদ্য পরিচিত এক আগন্তুককে আমার সাথে দেখে তিনি হয়তো আমার ঘনিষ্ঠজন ভেবে ভুলই করেছেন । অগত্যা চা – পানের আহ্বান , ইচ্ছে করেই নদী আর বাঁধের মাঝামাঝি নীচু বালিয়াড়ির টঙমার্কা খোলা জায়গায় চায়ের অর্ডার ; জুটলো আরো ক”জন পরিচিত । দেখা মিলল অযাচিতভাবেই ছোটোকন্যার ঘনিষ্ঠ বন্ধু তাবাসসুমের সাথে , আমাকে দেখেই মেয়েটি আনন্দে আত্মহারা । মন্দ লাগছিলো না পুরনো দিনের এমন আনন্দ আয়োজনের স্মৃতিতে হারিয়ে যেতে । রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা খাওয়া , আড্ডা দেয়ার মজাই আলাদা , কতো সময় যে ওভাবে আড্ডা দিয়ে পার করেছি সে হিসেব কখনও রাখিনি । অপরিচিত আগন্তুক এডভোকেট সাহেবের কাছে আমার সম্পর্কে , পরিবার সম্পর্কে বাবুল ভাইয়ের মূর্হুর্মূহু স্তুতিবাক্যে বিব্রত হলেও পুরনো সেই কথাটি আবারো উচ্চারণে যেনো বুকটা ভরে উঠেছিলো —- বললাম ,আমি জামালপুরে সকলের শ্রদ্ধায় – ভালোবাসায় রানীর ” মতো বিচরণ করেছি আজও করি ।
স্মৃতিতে – স্মরণে , মননে – মানসে জামালপুর।
ভালোবাসার জামালপুর
ভালোলাগার প্রিয় শহর …..
অনিঃশ্বেষ কৃতজ্ঞতা , ব্যাকুলিত চঞ্চলতা …
লেখিকাঃ অধ্যাপক, মালেকা আক্তার চৌধুরী
দর্শন বিভাগ ও সাধারণ সম্পাদক ,
শিক্ষক পরিষদ, সরকারি তিতুমীর কলেজ , ঢাকা
Leave a Reply