ডেস্ক রিপোর্টঃ
বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি ভয়াল দিন। সকালটি শুরু হয়েছিল অন্য সকালের মতোই। কিন্তু বেলা গড়াতেই সারাদেশ থেকে আসতে থাকে বোমা হামলার খবর। একটি দুটি জেলা নয়, একেবারে ৬৩ জেলায় বোমা হামলা। ৪৩৪ স্থানে! তাও প্রায় একযোগে। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট জঙ্গিদের বোমার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল সারাদেশ। ইতিহাসের পাতায় লেখা নজিরবিহীন এমন কাণ্ড আজও আতঙ্কিত করে দেশবাসীকে। মনে করিয়ে দেয়, ভয়ংকর এক ইতিহাসের কথা। আজকের নতুন প্রজন্ম যারা সেইসময়ে ছোট ছিল বা যাদের জন্ম সেই ভয়াল সময়গুলোর পরে, তাদেরও জানা উচিত সেদিনের সেই ভয়াল ঘটনাটির ইতিবৃত্ত। সেদিন বেলা সাড়ে ১১টায় দেশের ৬৩ জেলার ৪৩৪ স্থানে পরিকল্পিতভাবে একযোগে সিরিজ বোমা হামলা চালিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়েছিল নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)।
এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে যায় গোটা দেশের মানুষ। একমাত্র মুন্সীগঞ্জ জেলায় হয়নি বোমা হামলা। একযোগে ৬৩ জেলায় সংঘটিত সেই বোমা হামলায় তেমন কেউ হতাহত হয়নি বটে, তবে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। ঘটনায় দু’জন নিহত ও ১০৪ জন আহত হন।
ঘটনার পরপরই সারাদেশে ১৫৯টি মামলা দায়ের করা হয়। এরমধ্যে ডিএমপিতে হয়েছে ১৮টি মামলা, সিএমপিতে হয়েছে আটটি, আরএমপিতে চারটি, কেএমপিতে তিনটি, বিএমপিতে ১২টি, এসএমপিতে ১০টি, ঢাকা রেঞ্জে ২৩টি, চট্টগ্রাম রেঞ্জে ১১টি, রাজশাহী রেঞ্জে হয়েছে সাতটি, খুলনা রেঞ্জে ২৩টি, বরিশাল রেঞ্জে হয়েছে সাতটি মামলা, সিলেট রেঞ্জে হয়েছে ১৬টি, রংপুর রেঞ্জে আটটি, ময়মনসিংহ রেঞ্জে ছয়টি ও রেলওয়ে রেঞ্জে তিনটি। যারমধ্যে ১৪৩টি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। বাকি ১৬টি মামলায় ঘটনার সত্যতা থাকলেও আসামি শনাক্ত করতে না পারায় চূড়ান্ত রিপোর্ট দেওয়া হয়।
পুলিশ সদর দফতর ও র্যাবের তথ্য অনুযায়ী, এসব মামলায় এজাহারভুক্ত আসামি ছিল ১৩০ জন। গ্রেফতার করা হয় ৯৬১ জনকে। ১ হাজার ৭২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।
পুলিশ জানায়, সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় সারাদেশে ১৫৯টি মামলার মধ্যে ৯৬টি মামলার বিচার সম্পন্ন হয়েছে। ৯৬টি মামলায় ৩২২ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে। এর মধ্যে ১৫জনকে দেওয়া হয়েছে মৃত্যুদণ্ড। খালাস দেওয়া হয়েছে ৩৫৮জনকে, জামিনে রয়েছেন ১৩৩জন আসামি। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া আসামিদের মধ্যে ছিলেন বাংলা ভাই, শায়খ আব্দুর রহমান।
ইতিহাস বলছে, বিএনপি-জামায়াতের শাসন আমলে (২০০১-২০০৬) সরকারী এমপি মন্ত্রীদের মদদে সারা বাংলাদেশে শক্ত অবস্থান তৈরি করে জঙ্গিরা। অসাম্প্রদায়িক দেশ হিসাবে বাংলাদেশের নাম মুছে ফেলতে পরিকল্পনা করতে থাকে তারা। শুরু হয় জেএমবির আত্মঘাতি বোমা হামলা। ২০০৫ সালেই কয়েকটি ধারাবাহিক বোমা হামলায় বিচারক ও আইনজীবীসহ নিহত হন ৩০জন। আহত হয় ৪ শতাধিক।
৩ অক্টোবর জঙ্গিরা বোমা হামলা চালায় চট্টগ্রাম, চাঁদপুর এবং লক্ষীপুরের আদালতে। নিহত হন তিনজন। বিচারকসহ আহত হন কমপক্ষে ৫০জন। সিলেটে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক বিপ্লব গোস্বামীর ওপর বোমা হামলা। গাড়িচালকসহ তিনি আহত হন। ১৪ নভেম্বর ঝালকাঠিতে বিচারক বহনকারী গাড়ি লক্ষ্য করে বোমা হামলা। নিহত হন ঝালকাঠি জেলা জজ আদালতের বিচারক জগন্নাথ পাড়ে এবং সোহেল আহম্মদ। আহত হন অনেকে।
২৯ নভেম্বর গাজীপুর বার সমিতির লাইব্রেরিতে বোমা হামলা। ১ ডিসেম্বর গাজীপুর ডিসি অফিসের গেটে আবারো বোমা বিষ্ফোরণ। ঘটনায় নিহত হন গাজীপুরের কৃষি কর্মকর্তা আবুল কাশেম। আহত হন কমপক্ষে ৪০ জন। ৮ ডিসেম্বর নেত্রকোনায় ভয়াবহ বোমা বিষ্ফোরণ। ঘটনায় উদীচী শিল্প গোষ্ঠীর দু’নেতাসহ ৮ জন নিহত হন। আহত হন শতাধিক।
প্রজন্ম কি ভুলে যাবে সেসব ঘটনা? কখনোই না, প্রজন্ম ভুলে যায়নি সেসব। দেশটাকে একটা জঙ্গিবাদের দেশ হিসাবে গড়ে তোলার বহু চেষ্টা করেছিল বিএনপি-জামায়াত সরকার। কিন্তু পারেনি। কারন দেশটা যে তাজা রক্তের দামে কেনা।
বোমা হামলার ঘটনায় আদালত-মামলার জল গড়িয়েছে বেশ। চাঞ্চল্যকর এসব মামলা চাইলেই তো শেষ করে দেওয়া যায় না। আশা করা যায় শীঘ্রই শেষ হবে সেসবের বিচার কাজ। কলংকমুক্ত হবে দেশ-জাতি।
লেখকঃ
হাসান ইকবাল
সাধারণ সম্পাদক, ইতালী আওয়ামী লীগ
Leave a Reply