শাহিনুর রহমান সোনা, রাজশাহীঃ গোদাগাড়ী উপজেলার নিমঘুটু গ্রামের আলোচিত দুই আদিবাসী কৃষকের মৃত্যু রহস্য নিয়ে নানা মনে চলছে নানা গুঞ্জন। কেউ বলছেন জমিতে সেচের পানি না পাওয়ায় বিষপানে আত্মহত্যা করেছে তারা, কেউ বলছেন এটির পেছনে রয়েছে অন্য কোন কারণ আবার কেউ এ ঘটনাকে অন্য দিকে নিতেও রয়েছেন তৎপর।
এদিকে ঘটনার পর বিভিন্ন দলের
প্রতিনিধিরা এলাকা থেকে পরিদর্শন করে নিজ দলীয় কেন্দ্রে ইস্যু তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছেন। ঘটনার পর সরকারের পক্ষ থেকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের উচ্চতর তদন্ত কমিটি সরেজমিন তদন্ত করেছেন। ইতােমধ্যে তারা প্রতিবেদনও দাখিল করেছেন বলে জানা গেছে।
মৃঁত্যুর রহস্য এখনও জানা যায়নি। তবে ফরেনসিক রিপাের্ট আসার আগেই বিষপানে আত্মহননের ঘটনাকে নানা রং দেয়া হচ্ছে।
তারা আদৌ বিষপান করেছিল কিনা এ নিয়েও নানা প্রশ্ন রয়েছে বলে মনে করছেন অনেকেই।
ইতােমধ্যে দুই কৃষককে আত্মহত্যায় প্ররােচনার দায়ে গভীর নলকূপ অপারেটর
সাখাওয়াতকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশ তার রিমান্ডের আবেদন জানিয়েছে। বিএমডিএ সাখাওয়াতের অপারেটর পদ
থেকে অব্যাহতিও দিয়েছে। সবকিছুই আইনী প্রক্রিয়ায় চলছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সর্বশেষ ৬ এপ্রিল জাতীয় আদিবাসী পরিষদ কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক গণেশ মার্ডি পুলিশের রাজশাহী রেঞ্জের ডিআইজি বরাবর এক লিখিত বক্তব্যে গোদাগাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কামরুল ইসলামের অপসারণ-সহ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করেছেন।
জানতে চাইলে, বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী জিন্নুরাইন খান বলেন, বিষয়টি দুঃখজনক ; বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে সরেজমিন তদন্ত করা হয়েছে, সেখানে আত্মহত্যা নাকি অন্য কোন কারণ সেটা কেউ-ই বলতে পারেননি। তবে সেই জমি এবং আশেপাশের জমি গুলো পানির অভাবে ফেটে চৌচির হয়েছে বা ধান মরে যাচ্ছে এরকম কোন বিষয় দেখা যায়নি, জমি গুলো এবং ধান ক্ষেত স্বাভাবিক রয়েছে অর্থাৎ জমি শুকনো ছিল না এবং তা যথেষ্ট ভেজা অবস্থায় পাওয়া গেছে। ঐ এলাকার কোন কৃষক পানি না পাওয়ার অভিযোগ করেননি বরং বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষের পানি ব্যবস্থাপনায় তারা সন্তুষ্ট বলে জানিয়েছেন।
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির কেন্দ্রীয় সদস্য ও রাজশাহী মহানগরের সাধারণ সম্পাদক দেবাশীষ প্রামানিক দেবু বলেন, ‘ বিষয়টি খুবই দুঃখজনক, আজকে কৃষক কেন আত্মহত্যা করছে, বিষয়টি সরকারকে উপলব্ধি করতে হবে। বরেন্দ্র কর্তৃপক্ষের যে পানির ব্যবস্থা, সেখানে কৃষক আত্মহত্যা করেছে ; ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের যে প্রভাব পরিবেশের ওপর এবং কৃষকের ওপর পড়ছে, তা দুঃখজনক। আমরা সবসময়ই বলছি আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যে বক্তব্য, যে ভূ-উপরোস্থ পানির ব্যবহার করতে হবে। তা বাসতবায়ন হলে এ অঞ্চলের কৃষক উপকৃত হবে। তবে আমরা আস্থা রাখছি, মানবাধিকার কমিশনের যে উদ্যোগ আমরা দেখেছি, আমাদের রাজশাহী-২ আসনের সাংসদ জননেতা ফজলে হোসেন বাদশার ঐকান্তিক চেষ্টায় মানবাধিকার কমিশন বিষয়টি গুরুত্ব দিয়েছে এবং জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দিয়েছে। আমরা আশা রাখছি তারা ন্যায় বিচার পাবে।
গত ২৪ মার্চ দুপুরে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে একটি
গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছিলেন রবি। সেই সাক্ষাতকারের ভিডিও করা হয় । এতে দেখা যায়, হাসপাতালের মেঝেতে শুয়ে আছেন রবি মারান্ডি। রবির শিয়রের বামপাশে বসা তার মা দুলিনা মুর্মু। পায়ের দিকে দেয়াল ঘেঁষে বসা তার দুলাভাই। আর পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন রবির বােন ও নাটোর থেকে আসা ভাই। সবার সামনেই তাকে প্রশ্ন করা হয়-বিষ খেলেন কেন ? জবাবে রবি মারান্ডি বলেন, ‘বাড়ির সঙ্গে মিল হচ্ছিল না। কার সঙ্গে মিল হচ্ছে না- জানতে চাইলে তিনি আবারও স্পষ্ট করেই বলেন, ‘আমার পরিবারের সঙ্গে। বিষপানের পর গভীর নলকূপে পানি খেতে গিয়েছিলেন বলেও জানান রবি।
রবির পাশে বসে থাকা তার মা দুলিনা মুর্মু বলেন, গণ্ডগােল কিন্তু কাহাের সাথে নাই। আমাদের পাড়ার ডিপে (নলকূপ) গেছিল।
ভূঁইয়ে (জমিতে) পানি আবার লিছে (নিয়েছে)। তাে উঁইয়ে (বিষ) খায়েছে না কুণ্ঠে খায়েছে এখুন বলতে পারছি না।’ রবি পানি কি পায়নি- এমন প্রশ্নের জবাবে রবির
মা বলেন, পানি পায়েছে একটু আবার লিবে। প্রশ্ন করা হয় গণ্ডগােল কি হয়েছিল কারাে সাথে? তখন দুলিনা মুর্মু বলেন, পানি লিতে ডিপেও গণ্ডগােল নাই। বাড়িতেও গণ্ডগােল নাই। কীভাবে কী হলাে, না হলে সেটা আমি
বলতে পারছি না।তবে মৃত অভিনাথের স্ত্রী রােজিনা হেমব্রম অবশ্য বলছেন, গভীর নলকূপের অপারেটর সাখাওয়াত পানি না দেয়ায় বিষপান করেন তার স্বামী।
নিমঘুটু গ্রামের লাগােয়া আরেকটি গ্রাম ঈশ্বরীপুর । ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের খানিকটা সামনেই গভীর নলকূপ (ডিপ)। এই গভীর নলকূপকে ঘিরেই এখন নানা কথা চলছে। বলা হচ্ছে- এই ডিপের অধীনে বােরাে চাষ করেছিলেন রবি মারান্ডি ও অভিনাথ । কিন্তু অপারেটর সাখাওয়াত সেচের জন্য পানি দেয় নি জমিতে। কয়েকদিন ঘুরে ঘুরেও পানি না দেয়ায় তারা ক্ষোভে বিষপান করে।
ঘটনার পর রবি মারান্ডিকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছিলেন দামকুড়াহাটের পল্লীচিকিৎসক মুর্শেদ। তিনি বলেন, রবির মুখ থেকে চুয়ানির দুর্গন্ধ পেয়েছি।
মরদেহের ময়নাতদন্ত হলেও ভিসেরা রিপাের্ট এখনও হাতে না পাওয়ায় মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হতে পারেনি রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগ। ময়না তদন্তকারী চিকিৎসক কফিল উদ্দিন
জানিয়েছেন, ভিসেরা রিপাের্ট পেলে
মৃত্যুর কারণ জানা যাবে।
এ বিষয়ে রাজশাহীর জেলা প্রশাসক আব্দুল জলিল বলেন, কৃষি মন্ত্রনালয় থেকে একজন যুগ্ম সচিবকে আহবায়ক করে একটা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তাঁরা তদন্ত করে মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কাছে জমা দিয়েছেন। রিপোর্টে কি আছে তা এখনও আমার জানা নাই। আর মৃত্যুর বিষয়ে পুলিশ তদন্ত করছে। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কিছু জানা যাচ্ছে না।
Leave a Reply